সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে ছয়দিন ধরে জিম্মি অবস্থায় আছেন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজের ২৩ নাবিক। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় পরিবার ও জাহাজ মালিকপক্ষের সঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে যোগাযোগ করেছেন ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের কেউ কেউ।
কিন্তু হঠাৎ, গত শনিবার থেকে যোগাযোগের আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আর বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকদের জিম্মি করার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি জলদস্যুদের সঙ্গে।
এ অবস্থায় জাহাজ কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সূত্র যতই বলুক, জিম্মি নাবিকরা এখন পর্যন্ত সুস্থ আছেন, তবে উৎকণ্ঠা কাটছে না ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর।
অবশ্য, ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি ছাড়িয়ে আনতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাহাজটির মালিকপক্ষ। তবে, জলদস্যুদের নীরবতায় মিলছে না সমঝোতার উপায়; কঠিন হয়ে পড়েছে উদ্ধার প্রক্রিয়া।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানান, এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার উপকূলের একেবারে কাছেই রয়েছে। যুদ্ধ ছাড়া এ রকম উপকূলীয় এলাকায় আরেক দেশের সীমানায় অভিযান চালানো যায় না।
দস্যুরা কখন যোগাযোগ করতে পারে জানতে চাইলে ১৩ বছর আগে সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া এমভি জাহান মণি জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন ফরিদ।
আহমেদ শনিবার (১৬ মার্চ) রাতে জানান, ‘দস্যুরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণত যোগাযোগ করে। যোগাযোগের জন্য তাদের প্রতিনিধি থাকে। স্যাটেলাইট ফোনেই তারা যোগাযোগ করে।’
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ভারত মহাসাগরে নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে দস্যুরা জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রিত উপকূলে নিয়ে যায়।
এরপর তিন দফা স্থান পরিবর্তন করে জাহাজটি সরিয়ে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে জাহাজটি গ্যারাকাদ উপকূল থেকে সাত নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল।
সেখান থেকে শুক্রবার জাহাজটিকে ৪০-৪৫ নটিক্যাল মাইল উত্তরে নিয়ে যায় দস্যুরা। পরে জাহাজটি সোমালিয়ার গদবজিরান শহর থেকে আরও চার নটিক্যাল মাইল দূরে সরে যায়। এখনও জাহাজটি সেখানেই অবস্থান করছে বলে জানা গেছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) সূত্রে।
এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নাবিকেরা জানান, দস্যুরা যোগাযোগ করার আগে নাবিকসহ জাহাজটি উদ্ধারে সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে না।
তবে সমঝোতার কাজ এগিয়ে রাখতে জাহাজের মালিকপক্ষ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে রেখেছে।কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, নাবিকেরা সুস্থ আছেন।
এতটুকু বলতে পারি। জাহাজও একই অবস্থানে রয়েছে। তবে দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি এখনো, যদিও আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
এদিকে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজটি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কোনো হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে ভারতীয় নৌবাহিনী এক্সে শনিবার জানিয়েছে।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি করা মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন জাহাজকে প্রায় ৪০ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী।
এ সময় ১৭ জন নাবিককে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জাহাজে থাকা ৩৫ জলদস্যুর সবাই আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানানো হয়। ইতোমধ্যে এমভি রুয়েনের নাবিকদের উদ্ধার ও জিম্মিদের আত্মসমপর্ণের চারটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে।
এর আগে ১৪ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্স নিজেদের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মি করার কাজে সোমালিয়ার জলদস্যুরা তাদের হাতে জিম্মি এমভি রুয়েন ব্যবহার করে থাকতে পারে। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন ছিনতাই করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
ভারতীয় নৌবাহিনীর এক্সে শনিবার ও গতকাল প্রকাশ করা ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধজাহাজের সমন্বয়ে ভারত মহাসাগরে এই অভিযান পরিচালনা করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। প্রায় ৪০ ঘণ্টার অভিযানে সাফল্য ধরা দেয়।
তবে এমভি রুয়েন উদ্ধার করলেও বাংলাদেশি জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এভাবে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা বিপজ্জনক বলে মনে করছেন নৌ খাতের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনরা।
তারা বলছেন, এমভি রুয়েন সোমালিয়ার উপকূল থেকে অনেক দূরে ছিল। সেখানে বিভিন্ন দেশের নাবিকেরা জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। আবার জাহাজটি উদ্ধারে মালিকপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার প্রক্রিয়া সেভাবে না-ও হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কা থাকলেও অভিযানের বিকল্প নেই।
অন্যদিকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের মালিক বাংলাদেশি, নাবিকেরাও বাংলাদেশি। জাহাজের মালিকপক্ষ নাবিকদের জীবন বাঁচানোকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
এ কারণে বাংলাদেশি জিম্মি জাহাজ ছিনতাই করার সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সের একটি জাহাজ পিছু নিয়েছিল।
বে কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি।কারণ, নাবিকদের জীবনের শঙ্কা থাকায় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জিম্মি জাহাজে অভিযানের জন্য অনুমতি দেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, দস্যুরা যেহেতু নাবিকদের জিম্মি করে রেখেছে।
এখন কোনো অভিযান হলে নাবিকদের জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নাবিকদের প্রাধান্য দিতে গেলে সমঝোতার বিকল্প নেই।
এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কবির গ্রুপেরই জাহাজ ‘এমভি জাহানমণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিরা মুক্তি পান। ১৫ মার্চ তারা দেশে ফিরে আসেন।