ফুটবলের প্রতি দেশের মানুষের যত আশা ও আবেগ, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে ফুটবল ফেডারেশন। এমন অভিযোগ ও অনুযোগ পুরনো। সুদীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বাফুফে সভাপতি হিসেবে দেশের ফুটবল গ্রেট কাজী সালাহউদ্দীন দায়িত্ব পালন করলেও দিনশেষে বৈশ্বিক পর্যায়ে সফলতার মুখ দেখেনি দেশের ফুটবল। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলেও ধরা দেয়নি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। এশিয়া কিংবা বিশ্ব ফুটবলে জায়গা নেওয়া তো বহুদূরের গন্তব্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে অবশেষে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দীন আগামী মাসের ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য বাফুফে নির্বাচনে সভাপতির পদে প্রার্থী হিসেবে থাকছেন না বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।
সবাই অবগত যে, ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার অধীনেই তাবৎ বিশ্বের দেশগুলোর ফুটবল ফেডারেশন পরিচালিত হয়ে আসছে। সেখানে ফুটবল ফেডারেশনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশে একজন সভাপতি হতে হলে সরকার দলের কৌশলী সমর্থন যে লাগে, তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।
কাজী সালাহউদ্দীনের সভাপতি প্রার্থী না হওয়ার কারণে এখন কে হবেন ফুটবলের ত্রাণকর্তা, তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে দেশের ফুটবল অঙ্গনে। অবশ্য বাংলাদেশের ফুটবল পিছিয়ে গেলেও জাতীয় দলে খেলোয়াড়দের মান অতীতের চেয়ে অনেক ভাল, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। হয়তো আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে সালাহউদ্দীন, চুন্নু, কায়সার হামিদ, মুন্না, সাব্বির কিংবা মামুন জোয়ারদারেরা ফুটবল পাগল দর্শকদের হৃদয়ের মণি কোঠায় আজ অব্দি জায়গা করে আছেন। কিন্তু, এখন মোরসালিন কিংবা রাকিবেরাও দুর্দান্ত ফুটবল খেলছে। সমস্যা হলো, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দেশগুলোও খেলার মানের বিচারে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ ঠিক এখনও সুবিধা করতে পারছে না।
অন্যদিকে দেশের তৃণমূল ফুটবল ধ্বংস হয়ে গেছে বলে মত ফুটবল বোদ্ধাদের। বাফুফে সাবেক সভাপতি এস এ সুলতান টিটো সব সময়ে বলে আসছেন যে, আমাদের জেলা ভিত্তিক লীগ, শেরে বাংলা আন্তঃজেলা ভিত্তিক লীগ, বয়স ভিত্তিক লীগ, আন্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলের নিয়মিত আসর না হওয়াতে ফুটবলের প্রসার হয়নি। সে কারণে ক্রিকেট এখন প্রধান খেলা হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। এর দায় কাজী সালাহউদ্দীন কিংবা সালাম মুর্শিদীদের নিতে হবে।
তৃণমূল ফুটবলের অগ্রসর সংস্কৃতি ধরা না দিলেও গেল এক যুগের মধ্যে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসর বসিয়ে তরফদার রুহুল আমিন নামে এক ব্যবসায়ী সাড়া ফেলেছিলেন। যিনি তখনকার সময়ের ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিয়ে চিটাগাং আবাহনীর ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে উচ্চাভিলাসী উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাবেক হুইপ শামসুল হকের ছত্রছায়ায় তিনি ফুটবলে ভূমিকা রাখতে চান, তা বারংবার বলতে চেয়েছেন। এমনকি তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবলের মাধ্যমে বাংলাদেশের ফুটবলকে বদলাতে চান, তা ঘোষণা করেন। কিন্তু কাজী সালাহউদ্দীনের সঙ্গে মতবিরোধে গিয়ে ফুটবল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি, তেমন খবর চাউর আছে।
তরফদার রুহুল আমিন, সাইফ স্পোর্টিং নামের একটি ক্লাব করেছিলেন। তবে স্বার্থ উদ্ধার না হওয়ায় ধীরে ধীরে ফুটবল থেকে নিজেকে দূরে সরাতে থাকেন। শেখ রাসেল শিশু কিশোর পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসাবে এক পর্যায়ে তিনি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সঙ্গে যুগপৎভাবে দাবা ফেডারেশন চালাতে থাকেন। বেনজীর আহমেদ ছিলেন সভাপতি। তরফদার রুহুল আমিন সহ-সভাপতি!
এদিকে গেল ১৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে যখন কাজী সালাহউদ্দীন আগামী নির্বাচনে আর সভাপতির পদে নির্বাচন করবেন না বলে ঘোষণা রাখেন। ঠিক তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ তারকা একটি হোটেলকে ভেন্যু করে বিএনপি নেতা ও সাবেক গোলরক্ষক গ্রেট আমিনুল হকের প্রকাশ্য উপস্থিতি ও সমর্থনে তরফদার রুহুল আমিন ২৬ অক্টোবরের নির্বাচনে বাফুফে সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন, তা জানিয়ে দেন।
সরকার পরিবর্তনের অনিবার্য বাস্তবতায় ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি তাবিথ আওয়ালও সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন, তেমন গুঞ্জন আছে। তিনি নিজেও বিএনপির প্রভাবশালী যুব নেতা।
ফুটবলের সাফল্য ধরা দেয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের অগণিত ফুটবল ভক্ত চায় যে, সংস্কার করে দেশের ফুটবলকে ঢেলে সাজানো হোক। তেমন বাস্তবতায় ফেডারেশন চালানোর জন্য সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও আন্তর্জাতিক দূতিয়ালী করার পারঙ্গম কোন সংগঠককে নির্বাচিত করা হোক। সারাদেশের ফুটবল কাউন্সিলরদেরকে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ, তারাই নির্বাচিত করবে ফুটবলের অভিভাবক কে হবেন, সেই প্রশ্নে। যদিও বিগত সময়ে নির্বাচনের আগে সকল কাউন্সিলরদেরকে রাজনৈতিক পর্যায় হতে বলে দেয়া হত, অমুক কিংবা তমুককে ভোট দিও।
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ফুটবলের স্বার্থ বিবেচনা করতে হলে আসন্ন ফুটবল ফেডারেশন নির্বাচনের জন্য সভাপতি হিসাবে বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ও ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান যোগ্য নাম। পেশাদারিত্বের প্রশ্নে, দায়বদ্ধতার প্রশ্নে ইমরুল হাসানের ওপর ভরসা রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করে দেশের সব পর্যায়ের সংগঠকেরা। ক্লিন ইমেজের এই সংগঠক যেভাবে ক্লাব ফুটবলে সাফল্য দেখিয়েছেন, তা স্বীকার না করার সুযোগই নেই বলে মত সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের। এরপরেই বিতর্কিত অবস্থান হলেও আধুনিকচেতা তরফদার রুহুল আমিনের নাম আসবে। তবে বিগত সরকারের সুবিধা নেওয়ায় বা দোসর হওয়ায় তরফদার কতটা সুবিধা করতে পারবেন তা নিয়েও জারি আছে জোর আলোচনা।