রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরের মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এছাড়া চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবে বলেও বার্তা পাওয়া যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) চীন সফররত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের (এক্সিম ব্যাংক) চেয়ারম্যান চেন হুয়াইউ অন্যান্য দেশে নিজেদের পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে বাংলাদেশে চীনা উৎপাদন কেন্দ্র স্থানান্তরে সহায়তা করার কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে চীনা অর্থায়িত অবকাঠামো ও জ্বালানি প্রকল্পগুলোর প্রধান অর্থায়নকারী এই প্রতিষ্ঠান এবারই প্রথম বাংলাদেশে চীনা বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করলো। এই সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর চীন দ্রুত নবগঠিত ইউনূস সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের প্রতিশ্রুতি দেয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশে আসে, যা দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, হাসিনা সরকারের পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে সক্রিয় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক শুরু করে এবং তাদের প্রতিনিধিদের চীনে আমন্ত্রণ জানায়, যা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আভাস দিচ্ছে। আর সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কোনো দেশে দ্বিপক্ষীয় সফর হিসেবে চীনে যান এই নোবেলবিজয়ী।
সফর চলাকালে চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে মুহাম্মদ ইউনূস আঞ্চলিক ঐক্যের কথা তুলে ধরে অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং সমৃদ্ধির জন্য এশিয়ার দেশগুলোকে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তৈরির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এশিয়াকে অবশ্যই একটি টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমাদের নির্ভরযোগ্য তহবিলের প্রয়োজন যা আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে। এশিয়া এখনও সবচেয়ে কম সংহত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। আমাদের অবিলম্বে বাণিজ্য সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, এশিয়ার দেশগুলোকে সম্পদ-দক্ষ কৃষিকাজকে উৎসাহিত করতে হবে এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক টেকসই কৃষি সমাধান সম্প্রসারণ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং ‘জলবায়ু-স্মার্ট’ কৃষিকাজে উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়াকে একটি শক্তিশালী প্রযুক্তিগত ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যা পুনরুদ্ধারমূলক, বিতরণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া উচিত। আমাদের জ্ঞান ও তথ্য ভাগাভাগি করতে হবে এবং প্রযুক্তির বিকাশ ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে। ডিজিটাল সমাধানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংক চেয়ারম্যান চেন হুয়াইউ-এর সঙ্গে আলাপকালে ড. ইউনূস বলেন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি চীনা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুত বাস্তবায়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশ বড় আকারে নতুন বন্দর তৈরি করছে, যা শুধু দেশীয় অর্থনীতির জন্য নয়, বরং নেপাল ও ভূটানের মতো স্থলবেষ্টিত দেশ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের জন্যও সহায়ক হবে।
আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) উদ্যোগের আওতায় চীন বাংলাদেশকে মোট ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে ২৬ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য এবং ১৪ বিলিয়ন ডলার যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ থাকবে। তবে এখন পর্যন্ত চীন ৩৫টি প্রকল্পের জন্য ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি বিআরআইয়ের আওতায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ৪% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে, এ সফরে বিআরআই থাকবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরের আগেই চীন নীতিগতভাবে বাংলাদেশের জন্য ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি দেয়। যা চীনের আগ্রহের অন্যতম প্রকাশ।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন চীনকে অনুরোধ করেন যেন সুদের হার ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়, প্রতিশ্রুতি ফি মওকুফ করা হয় এবং অগ্রাধিকারমূলক ক্রেতা ঋণ ও সরকারি সুবিধাজনক ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ২০ বছর থেকে ৩০ বছর করা হয়। ওয়াং ই বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সুদৃঢ় ইতিহাসের প্রশংসা করেন এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধিতে নীতিগতভাবে সম্মতি জানান। তবে তিনি সুদের হার কমানোর বিষয়ে শুধু ‘বিবেচনা করার’ আশ্বাস দেন। এ ছাড়া চীন ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় থাকবে।
জানা যাচ্ছে, সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা। চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল বিশেষভাবে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করা হবে। এ ছাড়া চীন ঢাকায় একটি আধুনিক ও উন্নতমানের হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
আলোচনার বিষয়ে থাকবে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদ–সংক্রান্ত ইস্যু। বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্পকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্য হিস্যার অভাবে ভুগছে—হোক তা ভারতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে বা ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে। ফলে এই বিষয়টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক ইউনূস সম্ভবত চীনের নেতাদের সামনে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করবেন।
চীন এবং বাংলাদেশ উভয়েই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখলেও বাস্তবে এই সংকটের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে প্রত্যাবাসন দ্রুত সম্ভব না হলেও এ সফরের ইতিবাচক একটি দিক হতে পারে রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন তহবিল সংগ্রহের আলোচনা।
এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হতে পারে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে সংলাপের একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যার মধ্যে আরাকান আর্মিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখলে, এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা যায়। এই সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার এবং তা নিশ্চিত করতে চীন সহায়তা করতে পারে।
বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে উত্তেজনার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার এই চীন সফর ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চার দিনের সফর সফর শেষে শনিবার চীনের একটি উড়োজাহাজে বেইজিং থেকে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। এই সফরে ৫৭ জনের একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে রয়েছে।
ইবাংলা/এসআরএস