সূত্র: একাত্তর. টিভি
দেশের মানুষের বহু কাঙ্খিত সেই দিনটির ঘোষণা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানান, ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর নির্বাচন কমিশন (ইসি) উপযুক্ত সময়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
শুক্রবার (৬ জুন) সন্ধ্যায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এই ঘোষণার পর চঞ্চল হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। বিভিন্ন দলের নেতারা জানিয়েছেন নানা প্রতিক্রিয়া।
তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের কথা বলেছে সেগুলো আমলে না নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অনুপযোগী বর্ষা, পরীক্ষা, রোজার সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন।
সার্বিক বিবেচনায় জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে পারতো যেটি গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু সেটি প্রধান উপদেষ্টা আমলে নেন নাই। তিনি বলেন, বাকি প্রতিক্রিয়া দল ও যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জানাবো।
প্রধান উপদেষ্টার আজকের ভাষণে বন্দর নিয়ে আলোচনা আশা করেন নাই উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন ম্যান্ডেটহীন সরকারের জাতীয় ইস্যু নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার আছে কি না সেই প্রশ্ন রাখেন।
জামায়াতে ইসলামী
দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে এবং ঘোষিত সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা প্রকাশ করছে।
তিনি আরও বলেন, জাতির তীব্র আকাঙ্খার সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলো হতাশ হবে। তার ভাষ্য, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের দাবিগুলো তেমন করে আমলে নেন নাই।
আবহাওয়া বিবেচনায় এপ্রিল মাস ভোটের জন্য উপযুক্ত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, রোজার আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ভোটের জন্য একই সঠিক সময়।
সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে বোঝাতে পারেন নাই কেন নির্বাচন ডিসেম্বরে নয়।
তিনি মনে করেন, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি, এর পর নির্বাচন যাওয়া ঠিক নয়। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে যারা বিদেশিদের দেওয়ার কথা বলছে প্রধান উপদেষ্টা তাদের প্রতিহত করার কথা বলেছেন। করিডোর প্রশ্ন তিনি অস্বীকার করলেন। এক ধরণের প্যাসেজ আলোচনা ছিলো তার থেকে তিনি বেড়িয়ে গেলেন। সরকার রাজনৈতিক দলকে দূরে রেখে কাজ করছে।
প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কট নতুন মাত্রা পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, এটা একটা অগ্রগতি বলে মনে হলেও এখানে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কেননা দেশের মানুষ ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। আমরাও তা-ই চাই।
তিনি বলেন, কেন কালক্ষেপণ করে এপ্রিলে নির্বাচনের কথা বলছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে কী কী কাজ করতে চান তা-ও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
সব মিলিয়ে আরও অধিক সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকলে জনজীবনের সঙ্কটেই ঘনীভূত হবে বলে আমরা মনে করছি।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশনকে এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা বলা হবে এবং তার আগে অবাধ গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবেন। এটা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, এটি আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। এ বিষয়ে আমাদের দলের প্রেসিডিয়াম, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কথা বলে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
এনসিপি
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের দিনক্ষণের ঘোষণা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। তবে তার আগে জুলাই সনদ, দৃশ্যমান বিচার এবং সংস্কার হতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরণের অস্থিরতা প্রশমিত হয়েছে। একই সঙ্গে বন্দর, মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে উদ্বেগ দূর করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, রাষ্ট্রসংস্কারই ছিলো জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান লক্ষ্য এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কর্তব্য । সেই সংস্কার কাজের যে অগ্রগতির বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন তাতে আমরা আশান্বিত হয়েছি।
আমরা প্রত্যাশা করি তিনি ও তার সরকার সকল বাঁধা উপেক্ষা করে সংস্কারের কাজ শেষ করবেন। বিচারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতির বিবরণ দিয়েছেন তা জাতিকে আশ্বস্ত করেছে।
পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, কোরবানির চামড়া যা মূলত গরীবদের হক তা নিয়ে বিগত সরকার সীমাহীন জালিয়াতি করেছে। সরকার এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, তা আশাব্যঞ্জক। একই সঙ্গে হজ নিয়ে গৃহীত পদক্ষেপের সুফল জাতি পেয়েছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এই সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সাধুবাদ যোগ্য। অর্থনীতির সংস্কার এবং দেশকে সঠিক ধারায় উত্তরণে এই সরকারের যে প্রচেষ্টা প্রধান উপদেষ্টা তুলে ধরেছেন, তার প্রশংসা করতেই হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন; দেশ যুদ্ধাবস্থায় আছে। নানামুখী চক্রান্ত ও অপপ্রচার দেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরছে।
এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা দেশের স্বার্থেই আবশ্যক। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কুয়াশা রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলো তা আজকে কেটে গেছে। ফলে সংস্কার ও বিচারের কাজে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার যে আহবান তিনি করেছেন তাতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরাবরের মতো সাড়া দেবে।
হেফাজতে ইসলাম
দলটির নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রব্বানী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে দিন ঘোষণা করেছেন তা সঠিক নাকি ভুল এই বিবেচনা দেশবাসী করবেন।
তবে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা মনে করি, এপ্রিল থেকে দুই-এক মাস আগেও নির্বাচন হতে পারে। তবে সেটি প্রধান উপদেষ্টা পুনরায় বিবেচনা করবেন বলে আমরা আশা করি।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্বাস প্রধান উপদেষ্টা কোনো চাপের কারণে এই তারিখ ঘোষণা করেন নাই। তিনি অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছন শুধু।
এবি পার্টি
দলটির চেয়ারম্যান বলেন, এপ্রিল মাসে আমাদের আবহাওয়াজনিত একটা থ্রেট আছে। প্রধান উপদেষ্টা বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের যে রূপরেখা দিয়েছেন, তার ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। এখনে ষড়যন্ত্র বা চাপ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে এপ্রিলের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলন
প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় স্বাগত জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি। তবে নির্বাচনের সময়টা সমর্থন করছেন না তিনি।
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত সময় নির্ধারণের আহবান জানান।
এপ্রিল মাস নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
এদিকে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় যৌক্তিক। সব রাজনৈতিক দলগুলোর এটি মেনে নেওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশনের এখন অনেক কাজ আছে করার। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, পর্যবেক্ষক বিধিমালা ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এর কাজ আছে।
আরও পড়ুন…এপ্রিল কোনোভাবেই উপযোগী নয় নির্বাচনের জন্য: মির্জা ফখরুল
এই ৯ মাস সময় নির্বাচন কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আগেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নির্বাচন হয়েছে, তবে সংস্কার ছিলো না। এখন যেহেতু সংস্কারের ইস্যু আছে সময়টা যৌক্তিক।