আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

বিশেষ প্রতিনিধি

বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেওয়া উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী সেই বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আজ গৌরবোজ্জ্বল ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি এবার পা রাখছে তিয়াত্তর বছরে। এ উপলক্ষ্যে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

এতে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের লক্ষ্যই হলো দেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া এবং বিশ্বে বাঙালি জাতিকে একটি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস দলের মধ্যে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ও গণতন্ত্রের চর্চা অটুট থাকলে কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ পথচলায় অর্জন যেমন পাহাড়সম, তেমনই এসেছে নানা বাধাবিপত্তি, দুর্যোগ-দুর্বিপাকও। জাতির পিতাকে হত্যা, দলে ভাঙন, নেতাদের দলত্যাগ, সামরিক জান্তাদের রোষানল, নিষেধাজ্ঞা, হামলা-মামলাসহ নানা সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে দলটিকে।

শেখ হাসিনা এখন দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় দেশে দারিদ্র্য কমেছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। এছাড়া আরও অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে।

দেশের সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের ফানুস উড়িয়েই ৭৩ বছরে পা দিল টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণে জনপ্রিয়তা অর্জন ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে আওয়ামী লীগ। বারবার হোঁচট খেয়ে দলটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন যতটুকু শক্তিশালী, তা যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ঈর্ষণীয়।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য স্বত্ব হিসেবে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ।

এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রত্যুজ্জ্বল। দলটির বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই এটি বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে।

রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ছবি: সংগৃহীত

টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি যখন ইতিহাসের সবচেয়ে ‘সুসময়’ পার করছিল, তখনই সামনে এসেছে এক ব্যতিক্রমী চ্যালেঞ্জ। আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত দলটিকে এবার লড়াই করতে হচ্ছে নতুন মহামারি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচানো এবং তাদের জীবন-জীবিকার পাশাপাশি স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকাও সচল রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাতচল্লিশের দেশ ভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন।

বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের যুগান্তকারী নির্বাচন আর ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন সবখানেই সরব উপস্থিতি ছিল আওয়ামী লীগের। অধিকাংশ আন্দোলনের কৃতিত্ব এককভাবে আওয়ামী লীগের।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

প্রথম কাউন্সিলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হককে যথাক্রমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বন্দি অবস্থায় তাকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

এতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়।

‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। পরে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি পদে মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক পদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন।


আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

’৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে দলের আন্তর্জাতিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। আর মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়। ১৯৬৪ সালে দলটির কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন।

১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এর পরে ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় পঁচাত্তরে কারাগারে ঘাতকদের হাতে নিহত জাতীয় নেতাদের অন্যতম এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন মো. জিল্লুর রহমান।

২০১৮ সালে ২৩ জুন আওয়ামী লীগের নব নির্মিত নতুন ভবন উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। ছবি : সংগৃহীত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আসে আওয়ামী লীগের ওপর মরণাঘাত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবারও স্থগিত করা হয়।

১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে মহিউদ্দিন আহমেদ ও বর্তমান সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে।

১৯৭৭ সালে এই কমিটি ভেঙে করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এতে দলের আহ্বায়ক করা হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক উকিলকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুর রাজ্জাক।

এরপরই শুরু হয় আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব। উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়া। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

দেশের মাটিতে ফিরে আসার আগেই ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আবদুর রাজ্জাক। আবারও আঘাত আসে দলটির ওপর।

১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।

১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং মো. জিল্লুর রহমান যথাক্রমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে।

২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং আব্দুল জলিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।

তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আর এই কাউন্সিলের মাধ্যমে তারুণ্যনির্ভর কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা।

এরপর ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন।

২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে।

করোনার কারণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এবার জমকালো কোনো আয়োজন নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে ও অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

এসব কর্মসূচির মধ্যে বুধবার (২৩ জুন) সূর্যোদয়ের সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৯টায় সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন।

বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ই বাংলা/ আই/ ২৩ জুন, ২০২১

Comments (0)
Add Comment