রাজধানীতে প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে-রাতে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে ব্যাটারিচালিত যান্ত্রিক রিকশা। হালকা যানে অস্বাভাবিক গতির কারণে হরহামেশা ঘটে দুর্ঘটনা। গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সড়কে প্রায় উল্টে যায় যান্ত্রিক রিকশা। নিষেধাজ্ঞা থাকলে রাজধানীর প্রতিটা সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ ও বিপজ্জনক এ যানটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে হাই কোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিল। তবে এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে প্রতিদিনই বাড়ছে এই রিকশার সংখ্যা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, প্রতিটা অলিগলি এই বিপজ্জনক যান্ত্রিক রিকশার দখলে। প্রতিটি এলাকায় মোড় দখল করে নিয়েছে এই বাহনটি। মাঝে মাঝে উঠে যাচ্ছে মূল সড়কে। দ্রুতগতির ভারী যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। ঘটছে হতাহতের ঘটনা। যানবাহনটিকে বন্ধ করতে হাই কোর্টের নির্দেশ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও বন্ধ হয়নি। গত দুই বছর ধরে পুলিশ ও দুই সিটি করপোরেশন একাধিকবার ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও প্রকারান্তরে এই যানের সংখ্যা বাড়ছেই। নিবন্ধন না থাকায় এসব অবৈধ রিকশা থেকে কোনো রাজস্বও পাচ্ছে না সরকার। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাসোহারা দিয়ে চলছে এসব অবৈধ রিকশা।
জুনে সড়কে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা নিয়ে এক সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশায় শুধু সামনের চাকায় ব্রেক, পেছনের চাকায় ব্রেক নেই বা থাকলেও তা অপ্রতুল। এগুলো যখন ব্রেক করে, যাত্রীসহ গাড়ি উল্টে যায়। এ জন্য ইঞ্জিনে রূপান্তর করা ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরপর পুলিশ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অভিযানে নেমে বেশ কিছু রিকশা জব্দ করে। আবার থেমে যায় অভিযান।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা রিকশার নতুন নিবন্ধন দেওয়া শুরু করেছি। রিকশা থেকে ব্যাটারি নামাতে বলেছি। যারা নিবন্ধনের আবেদন নিয়েছে, তারা সবাই জমা দেওয়ার অপেক্ষা করছি। নিবন্ধন দিয়ে ফের অভিযান শুরু করব। উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, করোনার কারণে এখন অভিযান বন্ধ। আবার শুরু হবে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই অবৈধ এসব রিকশা রাজধানীতে দাপিয়ে বেড়ানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রধান সড়ককেন্দ্রিক। প্রধান সড়কে এসব রিকশা দেখলেই আটক করা হচ্ছে। অলি-গলিতে হয়তো চলছে। ট্রাফিক বিভাগের জনবল সংকট। তাও মাঝেমধ্যে অভিযান চালাই। এসব যান্ত্রিক রিকশা তৈরির যন্ত্রপাতি আমদানি বন্ধ হলে এমনিতেই এগুলো বন্ধ হয়ে যেত।
যাত্রীর চেয়ে রিকশা বেশি : কয়েক বছরে রাজধানীতে মোটরসাইকেল ও সাইকেলের সংখ্যা বাড়ায় রিকশার যাত্রী কমলেও বেড়েছে রিকশা, যা প্রতিদিন বাড়ছে। এর বেশির ভাগই ব্যাটারিচালিত ও অবৈধ। রিকশার জটলায় বন্ধ থাকে প্রতিটা গলিমুখ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা দখল করে যাত্রীর অপেক্ষা করছেন রিকশাচালকরা। ফলে বাড়ছে যানজট। জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ৯৯৭টি। উত্তর সিটিতে মাত্র ২৮ হাজার ১৬২টি। দুই সিটিতে নিবন্ধিত রিকশা আড়াই লাখের কম হলেও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে রাজধানীতে রিকশা চলছে ১১ লাখের বেশি, যার বড় অংশই ইঞ্জিনচালিত। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী রাজধানীতে চলাচলকারী রিকশার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। অবৈধ হওয়ায় এই বিপুলসংখ্যক রিকশা থেকে ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সেই সঙ্গে অসহনীয় হয়ে উঠছে যানজট পরিস্থিতি।
অভিজ্ঞতা ছাড়াই চালক : রংপুরে চাতালে কাজ করা সাইফুল সাত মাস আগে ঢাকা এসে পরিচিত একজনের সুবাদে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইঞ্জিনচালিত রিকশা চালানো শুরু করেন। সম্প্রতি রামপুরায় তার রিকশায় ভ্রমণকালে দেখা যায়, বাস ও ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনকেই জায়গা দিতে নারাজ সাইফুল। যানজটে একটু ফাঁক পেলেই সেখানে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন রিকশা। কখনো সাঁই করে ডানে চলে যাচ্ছেন, কখনো বামে। নিষেধ করলে তার জবাব, ?মামা, নিয়ম মেনে চালাতে গেলে সারা দিনে ৫টা ট্রিপও মারা যাবে না। সাইফুলের মতো লাখ লাখ মানুষ কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই রাজধানীতে রিকশা চালাচ্ছেন। এসব চালক অনেক সময় রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ঘটছে দুর্ঘটনা। নিয়ম না মানায় রাস্তায় যানজটও তৈরি হচ্ছে।
কোণঠাসা প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা : এদিকে ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশার কারণে কোণঠাসা প্যাডেলচালিত বৈধ রিকশাচালকরা। বনশ্রী এলাকার রিকশার চালক ষাটোর্ধ্ব মহিদুল ইসলাম বলেন, ৩০ বছর ধরে রিকশা চালান। এখন ইঞ্জিনের রিকশার সঙ্গে পেরে ওঠেন না। যাত্রীরা তাড়াতাড়ি যেতে ইঞ্জিনের রিকশায় ওঠেন। বয়স বেশি হওয়ায় গ্যারেজ মালিক ইঞ্জিনের রিকশা দিতে চান না। রিকশা চালিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইবাংলা / নাঈম/ ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১