শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) ক্রিসমাস ইভ। ওয়ালমার্টে আমার চাকরির ১৬ বছর হয়ে গেলো। হয়তো এটাই ওয়ালমার্টে আমার শেষ ক্রিসমাস।খুব সম্ভবত আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে ওয়ালমার্টের চাকরি থেকে বিদায় নেবো। ওয়ালমার্টে চাকরি শেষ করার পর হয়তো ‘ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার’ নামে বইটা লেখা শুরু করবো। সেই বইয়ে ক্রিসমাসের দিনগুলোর কথা নিশ্চয়ই লিখবো। কত স্মৃতি, কত গল্প অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়েছে!ষোলো বছরে অচেনা এই দেশের অচেনা মানুষের কাছে কিভাবে আমি একটু একটু করে চেনা হয়ে গেলাম!
পাঁচ বছর আগে দেখা কাস্টমার পথে ঘাটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে ‘হাই রিটা’ বলে নিজেই এগিয়ে এসে পাঁচ বছর আগে ওয়ালমার্টে আমি তার সাথে কী অমায়িক ব্যবহার করেছিলাম তা মনে করিয়ে দেয়, সবই লেখা হবে।ক্রিসমাস ইভ আগামীকাল। এই প্রথম আগামীকাল আমার ছুটি, ক্রিসমাস ইভে কারো ছুটি থাকে না। কিন্তু কেমন করে যেন কমপিউটার আমাকে ছুটি দিয়েছে!
এবার ক্রিসমাস ইভের হইচই, কাস্টমারদের হুড়োহুড়ি আমি মিস করবো। মিস করবো অনেক কিছুই।গতকাল আমার ডে অফ ছিল। আমি গেছিলাম থ্যাংকস গিভিং উপলক্ষে পাওয়া ২৫% ডিসকাউন্ট কার্ড নিয়ে বাজার করতে।কয়েকদিন আগে মিথীলার গাড়ির একটা চাকা পাংচার হয়ে গেছিলো। আমিই প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমার ২৫% ডিসকাউন্ট কার্ড ব্যবহার করে ওয়ালমার্ট থেকে মিথীলার গাড়ির পুরানো চার চাকা পালটে নতুন চাকা লাগানো হোক।
গতকাল মিথীলার গাড়ি নিয়ে আর দশজন কাস্টমারের মতোই আমি ওয়ালমার্টের অটো সেকশানে অপেক্ষা করছিলাম।হঠাৎ এক মাঝবয়েসী সাদা সাহেব এগিয়ে এসে আমায় বললো, মেরি ক্রিসমাস।প্রথমে একটু চমকে গেছিলাম, ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাকে কেন মেরি ক্রিসমাস বলছে!আমার গায়ে তো ওয়ালমার্টের ভেস্টও নেই যে সাহেব আমাকে ওয়ালমার্ট এসোসিয়েট ভাববে!
এবার সাহেব নিজেই বললেন, আজ কি তোমার অফ? তোমার গায়ে তো ভেস্ট নেই।বললাম, হ্যাঁ আজ আমার অফ। কিন্তু তুমি আমায় চিনলে কিভাবে!
সাহেব বললো, তুমি তো ইলেকট্রনিকস এসোসিয়েট! অনেকদিন আগে তুমি আমায় অনেক হেল্প করেছিলে।সেই সন্ধ্যায় আমার কিছু জরুরি ছবি প্রিন্ট করাতেই হবে, কিন্তু ততক্ষণে ফটো মেশিন বন্ধ হয়ে গেছিলো।কিন্তু তুমি আমার জন্য ফটো মেশিন অন করেছিলে। তুমি যত্ন করে ছবিগুলো প্রিন্ট করে দিয়েছিলে। আমার কী যে উপকার হয়েছিলো।আমি ঠিক চিনেছি তোমায়। তোমার এবারের ক্রিসমাস খুব ভালো কাটুক। মেরী ক্রিসমাস।
আমি বললাম, আমি ওয়ালমার্টে চাকরি করি। কাস্টমারকে হেল্প করা আমার কাজ। আমি সেদিন আমার কর্তব্য করেছিলাম, কিন্তু তুমি আমায় মনে রেখেছো। এতদিন পরেও তুমি দূর থেকেই আমাকে চিনে ফেলেছো, আমার খুবই ভালো লাগছে। মেরী ক্রিসমাস তোমাকেও, তোমার ক্রিসমাস খুব ভালো কাটুক।
প্রতি বছর ক্রিসমাসের কয়েক দিন আগে থেকে ক্রিসমাস ইভ পর্যন্ত কিছু কিছু কাস্টমার এসে আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে, “মেরী ক্রিসমাস! জেসাস লাভস ইউ। ইউ আর সো নাইস, সো কাইন্ড! ইউ আর গড’স চাইল্ড! গড ব্লেস ইউ!আমার কেন জানি কান্না পায় তখন। আমি তাদের কারো উপকার করিনি, চাকরির শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক সেবা দেই, বোনাস হিসেবে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করি। এত অল্পেই তারা খুশী।
আজকেও এক বুড়ো দম্পতি, আরেক বুড়ো ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্ট এসেছিল শুধু আমাকে মেরী ক্রিসমাস বলতে।এটাকে বলে রিকগনিশান। আমি মানুষটা ছোটো, চাকরিটাও ছোটো।কাস্টমারের খুব ছোট ধরণের উপকারই করি হয়তোবা, তবে উপকার করার সময় ‘উপকার করছি’ মাথায় থাকে না।খুবই ছোট কাজ হলেও আন্তরিকতা নিয়ে কাজটুকু করি। বিদেশ বিভুঁইয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে এই ধরণের রিকগনিশান পেলে মন ভালো লাগে। কাজ শেষে চলে আসার আগ মুহূর্তে এক ইয়াং ভদ্রলোক আমাকে এমন আবদারের সুরে ডেকে থামালো এবং অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, “কেমন আছো রিটা, মেরী ক্রিসমাস। আমি মনে-প্রাণে চাই, তোমার এবারের ক্রিসমাস খুব ভালো কাটুক”।
আমি মনেই করতে পারছিলাম না তাকে কোথায় দেখেছি, কত দিন আগে দেখেছি! তবে আমিও পরিচিতের হাসি দিয়ে তাকে মেরী ক্রিসমাস বললাম।কেউ আমাকে মেরী ক্রিসমাস বললে মনে যতখানি সুখ পাই, আমি কাউকে মেরী ক্রিসমাস বলতে পারলে তার চেয়ে অধিক সুখ পাই।ওয়ালমার্টে ষোলো বছরে শুধু ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে তা কিন্তু নয়। খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছে, প্রায়ই হয়।কিন্তু ভালো অভিজ্ঞতা হয় অনেক গুণ বেশি, আর রিকগনিশান? দিন-তারিখ ধরে ধরে যদি বলি, সেটা হয়ে যাবে আদিখ্যেতা, আদিখ্যেতা করে লাভ কি? তার চেয়ে মনের আনন্দ মনেই রাখি, এভাবেই বেঁচে থাকি!
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী