কওমী শীক্ষার্থীরা ‘লাইনচ্যুত’ হওয়ার আশঙ্কা!
বিশেষ প্রতিনিধি :
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে দেশে দীর্ঘদিন ধরে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কওমি মাদ্রাসার পরিচালকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক বলছেন, অলস সময় কাটাতে গিয়ে ছাত্ররা ‘লাইনচ্যুত’ হয়ে যেতে পারে। ”বর্তমান হচ্ছে, ইন্টারনেটের যুগ, শিক্ষার্থীরা সময় পার করার জন্য অন্য মাধ্যম খুঁজে নিচ্ছে,” বলে জানিয়েছেন এক মাদ্রাসা শিক্ষক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার।
হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, কওমি মাদ্রাসা যেহেতু অনেকাংশে আবাসিক, ছাত্র-ছাত্রীদের ভাল-মন্দ নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ছেন অনেক শিক্ষক, যারা নিজেদেরকে অভিভাবকও মনে করেন। ”কওমি মাদ্রাসায় অনেক গরীব, এতিম ছাত্র আছে, এতিম ছাত্রদের সবকিছু দেখাশুনা করা হয় মাদ্রাসায়, “
সরকারের সাথে দেন-দরবার : এরকম বিভিন্ন যুক্তি নিয়ে মাদ্রাসা খুলে দেয়ার জন্য সরকারের সাথে দেন-দরবার শুরু করেছে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী এ ব্যাপারে সোমবার (৫ জুলাই) রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটা বৈঠকও করেছেন।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতদিন বন্ধ থাকবে, ততদিন মাদ্রাসাও বন্ধ থাকবে। হেফাজত মাদ্রাসা খোলার দাবিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে কেন?
একদিকে অনেক নেতা কর্মীর গ্রেফতারের ঘটনায় চাপের মুখে রয়েছে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব। অন্যদিকে কয়েক মাস ধরে সরকারি নির্দেশে মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ চাপে পড়েছে এই সংগঠন।
হেফাজাতের অনেক নেতা মনে করেন, মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় হেফাজতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সরকার সুযোগ পেয়ে মাদ্রাসা বন্ধ করে রেখেছে। এনিয়ে তাদের ভেতরে হেফাজতের নেতৃত্বেরও সমালোচনা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে হেফাজতের শীর্ষ দু’জন নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে গিয়ে মন্ত্রীর সাথে দেখা করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আশ্বাস’ প্রমাণহীন : হেফাজতে ইসলামের নেতা নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, মাদ্রাসাগুলোর টিকে থাকার বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে ঈদের পরে যাতে খুলে দেয়া হয়, তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই তাগিদ দিয়েছেন। “সব মাদ্রাসা বন্ধ। সেজন্য সব ধরনের মাদ্রাসা খুলে দেয়ার জন্য বলার দাবিও করেন তারা।
হেফাজত নেতা জেহাদী বলেন, মন্ত্রী তাদের এমন আশ্বাস দিয়েছেন যে, লকডাউন শেষ হলে এবং ঈদের পরে মাদ্রাসা খোলার ব্যবস্থা নেবেন। তবে জেহাদীর এমন আশাবাদের প্রমাণ কোন গণমাধ্যমকে দিতে পারেননি। অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতদিন বন্ধ থাকবে, ততদিন মাদ্রাসাও বন্ধ থাকবে।’
দেশে গত বছরের মার্চে যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়, তখন বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের সব স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাগুলো খোলা ছিল।
এবছর মার্চ মাস থেকে কওমি মাদ্রাসাগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে এব্যাপরে মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অনেকে মনে করেন, হেফাজতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর সরকার এমন অবস্থান নিয়েছে।
মাদ্রাসা খোলার
হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেছেন, তাদের মাদ্রাসা বেশি সময় বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা সংকটে থাকবে- সেজন্য মাদ্রাসা খুলে দেয়া জরুরি ও মানবিক কারণ বলে তারা মনে করেন। তিনি আরও বলেন, কওমি মাদ্রাসায় অনেক গরীব, এতিম ছাত্র আছে, মাদ্রাসার শিক্ষকরাই যাদের অভিভাবক। ”তারা আবাসিকে থাকে। তাদের লালন পালন, খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু দেখাশুনা করা হয় মাদ্রাসার থেকে। এছাড়াও এখন যদি কওমি মাদ্রাসা মাসের পর মাস বন্ধ রাখা হয়, তাহলে ছাত্ররা বিচ্যূত হবে বা লাইনচ্যূত হয়ে যাবে” বলে মনে করেন মি: নিজামপুরী।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার মেয়েদের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার বলেছেন, মাদ্রাসা দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়বে। “বর্তমান হচ্ছে, ইন্টারনেটের যুগ। এখন যদি বাচ্চারা পড়া লেখা থেকে দূরে থাকে, তাহলে তারা সময় পার করার জন্য অন্য মাধ্যম খুঁজে নিচ্ছে,” তিনি বলেন। ”তারা আসল রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছে। এজন্য মাদ্রাসা খোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।”
হাটহাজারী মাদ্রাসার মিঃ নিজামপুরী বলেন, প্রতিবছরের মতো এ বছরও মে জুন মাসে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে এবং ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় আসতে পারছে না। নানামুখী চাপে হেফাজত
সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ডাটাবেজ তৈরি করা এবং কওমি মাদ্রাসার নিবন্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই বিষয়ও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনগুলোকে চাপে ফেলেছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার মামলায় গ্রেফতারর নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি নিয়ে এর আগে হেফাজতের মহাসচিব কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন। এখন জুনায়েদ বাবুনগরীও দেখা করলেন।
নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, সরকার যাতে তাদের দাবিকে গুরুত্ব দেয়, সেজন্য তারা দেখা করেছেন। “আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। এ মামলাগুলো বেশিরভাগ মিথ্যা মামলা। তা আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখিয়েছি।” জেহাদী আরও বলেছেন, “মামলা হলেই গ্রেপ্তার করে রাখতে হবে, এটা ঠিক নয়।” চাপের মুখে হেফাজতের নেতৃত্ব সরকারের সাথে সমঝোতার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সহিংসতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের ব্যাপারে আইনের বাইরে সরকারের কিছু করার নেই। সূত্র : বিবিসি বাংলা
ই-বাংলা/হেফাজত/ ৭ জুলাই, ২০২১