শীতে মুসলিমদের জন্য বড় একটা সমস্যা হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে অজু করা। কারণ ঠান্ডার কারণে অজু করা বেশ কষ্টের হয়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায় অজু করার ভয়ে অনেকেই নামাজই পড়তে চান না। যা মোটেও সঠিক নয়।তবে শীত ও অন্য কোনো অসুবিধার কারণে বা সুবিধার্থে অজু সহজ করা হয়েছে। অর্থাৎ অজু সহজভাবে করার জন্য পা ধোয়ার পরিবর্তে মোজার ওপর মাসেহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শরিয়ার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে।
এই বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম এর যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বিশদ আলোচনা করেছেন।
যে ধরনের মোজার ওপর মাসেহ করা যায়: মোজা এমন হতে হবে যাতে, মোজা দ্বারা টাকনু ঢাকা থাকে। মোজা বাঁধা ছাড়াই পায়ে লেগে থাকতে হবে। মোজা এমন হওয়া যে তাতে পানি না চোষে এবং তা ভেদ করে পানি পা পর্যন্ত না পৌঁছায়। মোজা এমন পুরু হওয়া, যাতে তার ওপর থেকে ভেতরের অংশ দেখা না যায় এবং এমন মজবুত হওয়া, যাতে জুতা ছাড়া শুধু মোজা পায়ে দিয়ে তিন মাইল পর্যন্ত হাঁটা যায়। এতে মোজা ফাটে না এবং নষ্টও হয় না। মোজা ফাটাছেঁড়া হলে পায়ের ছোট আঙুলের তিন আঙুল পরিমাণের কম থাকতে হবে (মুসলিম: ৩৫৪, আবুদাউদ: ২৪২০, আল-আশবাহ ওয়ান-নাযায়ির: ১/১১৪, মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা: ৩৭/২৬৫-২৬৪)।
সাধারণত চামড়ার মোজাই উক্ত রূপ হয়ে থাকে। তাই জমহুর ওলামায়ে কিরাম ‘জাওরাব’ তথা সাধারণ মোজার ওপর মাসেহ করতে নিষেধ করেছেন। চামড়ার মোজাকে ‘খুফ’ আর সুতা বা কাপড়ের মোজাকে ‘জাওরাব’ বলা হয়। চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ করা সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ। সুতার মোজার ওপর মাসেহ করা বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। (আবুদাউদ: ১৫৯, তিরমিজি: ৯৯, আহমাদ: ৪/২৫২, মাজমুআ ফাতাওয়া: ২১/১৮৪)।
মাসেহর জন্য মোজা পরিধানের নিয়ম: পা ধোয়াসহ পূর্ণ অজু করার পর মোজা পরলে তারপর থেকে পায়ের মাসেহ দুরস্ত হবে। (বুখারি: ১৯৯)।
মাসেহ করার পদ্ধতি: দুই হাতের ভেজা আঙুলগুলো দুই পায়ের আঙুলের ওপর রাখবে। এরপর হাত দুটি পায়ের পাতার ওপর দিয়ে টেনে আনবে। ডান পা ডান হাত দিয়ে মাসেহ করবে, বাঁ পা বাঁ হাত দিয়ে মাসেহ করবে। একত্রে দুই হাত দিয়ে দুই পা মাসেহ করবে। যেমনটি দুই কান মাসেহ করার ক্ষেত্রেও করা হয়। মাসেহ করার সময় হাতের আঙুলগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে রাখবে। একাধিকবার মাসেহ করবে না। (আল মুলাখ্খাস আল ফিকহি: ১/৪৩)।
মাসেহর সুন্নাত: পায়ের আঙুলের মাথা থেকে হাতের আঙুলগুলো প্রশস্ত করে টাকনু পর্যন্ত মাসেহ করা। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮৫, কিতাবুল আসার: ১/৭২)।
মাসেহর পরিমাণ: হাতের ছোট তিন আঙুলের সমান পায়ের ওপরের অংশ মাসেহ করা। (আবুদাউদ: ১৪০, সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ১৪৩৭, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮৫)।
মোজার ওপর মাসেহর নির্ধারিত সময়সীমা: মুকিম বা নিজ এলাকায় থাকা অবস্থায় এক দিন এক রাত অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মোজার ওপর মাসেহ করা যায় এবং মুসাফির বা পরবাসে তথা সফরে (কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে ৪৮ মাইল বা ৭৭ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার পথে এবং সেখানে পৌঁছে ১৫ দিনের কম থাকার ইচ্ছা করলে তাকে মুসাফির হিসেবে ধরা হয়) থাকাকালীন তিন দিন তিন রাত তথা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত মোজার ওপর মাসেহ করা যায় (আবুদাউদ: ১৩৫)। এই হিসাব শুরু হবে প্রথমবার মাসেহ করার সময় থেকে (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮০)।
মাসেহ ভঙ্গের কারণসমূহ: যেসব কারণে অজু ভঙ্গ হয়, সেসব কারণে মাসেহও ভঙ্গ হয় (তিরমিজি: ৬৯)। মোজা খোলার কারণে মাসেহ ভেঙে যায় (সুনানুল কুবরা, বায়হাকি: ১৪২২)। মোজা যদি পায়ের টাকনুসহ বেশির ভাগ অংশ বের হয়ে যায় (সুনানুল কুবরা, বায়হাকি: ১৩৯৬)। উভয় মোজার কোনো একটিতে বেশির ভাগ অংশে পানি পৌঁছে গেলে মাসেহ ভেঙে যায় (মুআত্তা মুহাম্মদ: ২/৫৮৭)।
উল্লেখ্য, পাগড়ি, টুপি, বোরকা ও নিকাবের ওপর মাসেহ করা জায়েজ নেই। হাতমোজার ওপরও মাসেহ করা জায়েজ নেই (আবুদাউদ: ১৪০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/২৩)।
মোজার ওপর মাসেহ কখন বাতিল হবে: নির্ধারিত সময় (২৪ ঘণ্টা বা ৭২ ঘণ্টা) শেষ হওয়ার মাধ্যমে মাসেহ বাতিল হয়ে যায় (বাদায়েউস সানায়ে: ১/৪৬)। অর্থাৎ ওই সময়ের মধ্যে অজু ভঙ্গের কারণ না ঘটে থাকলে আবার মাসেহ করা যাবে না বা মাসেহ ‘রিনিউ’ বা নবায়ন করা যাবে না। কিন্তু তখনো যদি অজু ভঙ্গের কোনো কারণ না ঘটে, তাহলে ওই অজুতেই সব ইবাদত করা যাবে। মুকিম যদি মাসেহ করার পর সফর আরম্ভ করে, তবে মুসাফিরের সময়সীমা পূর্ণ করতে পারবে, তদ্রূপ মুসাফির যদি মাসেহ করার পর মুকিম হয়ে যায়, তবে মুকিমের নির্ধারিত সময়ে তা সমাপ্ত হবে (মুসান্নাফে আব্দির রাজ্জাক: ১/২২১)।
ইবাংলা / নাঈম/ ২১ জানুয়ারি, ২০২২