কোনোভাবেই মানতে পারছি না। মানাতে পারছি না নিজেকে। এ কোনো কথা হতে পারে না। এভাবে চলে যাওয়ার কথা ছিল না। সব সময় বলতেন, বাকি জীবন দুই বন্ধু একসঙ্গে কাটাব। আমি বলতাম শেষ বয়সে আমরা একটা বৃদ্ধাশ্রম করব। সেখানে কাছের সব বন্ধুকে ডাকব। যৌবনের স্মৃতির বাক্স মেলে ধরব। কথা রাখেননি পীর হাবিবুর রহমান। চলে গেলেন আপনি। ৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ কথা হয় ফোনে। বললাম, আপনি যোদ্ধা। ক্যান্সার জয় করে এসেছেন। কোনোভাবে পরাজিত হতে পারেন না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে অফিসে আসুন। আবার আগের মতো বের হব। ডেকে নেব শাম্মী আর নুর মোহাম্মদকে। এবার টিটোনকেও রাখব মাঝে। হাসলেন। গলার স্বরে ক্ষীণতা। ক্লান্তি খেয়াল করলাম। একটু খারাপও লাগল। ভাবলাম হয়তো অসুস্থতার কারণে ক্লান্তি ভর করেছে। ঠিক হয়ে যাবেন। বললাম আপনার ভাবী আর আমি আসতে চাই। নিরাপদ দূরত্বে দেখে যাব। ফরিদা ইয়াসমিন বারবার তাগিদ দিচ্ছেন আপনাকে দেখতে যেতে। আপনি বললেন, এখন আসার দরকার নেই। আর কটা দিন যাক। তারপর ভাবীকে নিয়ে আসুন।
১ ফেব্রুয়ারি আপনার নম্বরে বারবার কল দিলাম। ধরলেন না। ২ তারিখ আপনার ছেলে অন্তর ফোন ধরে বলল, চাচ্চু, ফোন ধরার মতো অবস্থায় নেই বাবা। একটু সুস্থ হলে মিলিয়ে দেব আপনাকে। ৩ তারিখ আবার ফোন করলাম। কেউ ধরল না। চিন্তায় পড়লাম। ৪ তারিখ হঠাৎ জরুরি কাজে এলাম দেশের বাইরে। ৫ তারিখ প্রথম ফোনটি আসে ভাবীর কাছ থেকে। ভাবী বললেন, অবস্থা ভালো নয়। শেষ চেষ্টাটুকু করছি। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাব ভারতে। জরুরিভাবে মেয়ে এবং আমার ভিসার ব্যবস্থা করে দিন। ঢাকায় ফোন করছি ভাবী ও মেয়ের ভিসার জন্য। এমন সময় অন্তরের ফোনটি এলো। হাউমাউ করে কাঁদছে ছেলেটি। কিছুদিন আগে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেছে। অসুস্থ হওয়ার পর বাবার খুব খেয়াল রাখে। ছেলে, মেয়ে দুজনই ছিল আপনার জান। মেয়েকে নিয়ে অফিসে আসতেন। মেয়েটা যখন তখন ফোন করত। বাবার খবর নিত অফিসে কী করছে। সেই মেয়ের সঙ্গে কথা হলো। মেয়েটি কাঁদছে বাবার জন্য। নিজের চোখ সামলাতে পারছি না। এটা কিছু হলো না পীর। সবাইকে কাঁদিয়ে এভাবে যেতে পারেন না।
আমাদের দীর্ঘদিনের পথচলা। কঠিনতম এই সময়ে পথ অনেকের সঙ্গে চলি। সবাই বন্ধু হতে পারে না। ভাই হতে পারে না। সহকর্মীরা আরও পারে না। স্বার্থের এ দুনিয়ায় কেউ কারও নয়। অন্যের খারাপ কামনা করে মানুষের দিন কাটে। আপনি ছিলেন আলাদা। দীর্ঘ পথচলায় এক দিনের জন্যও আমাদের সম্পর্কের ডান-বাম হয়নি। ২০১১ সালে আমার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ প্রতিদিনে যোগ দিলেন উপসম্পাদক পদে। আমি সম্পাদক আর আপনি নির্বাহী সম্পাদক হলেন। ভাই-বন্ধুর মতো কাজ করতাম। কখনো ভিন্নমত হলেও আমার মতই মেনে নিতেন। অফিসের বাইরেও আমাদের সম্পর্কের একটা জগৎ ছিল। দুজন বাইরে বসতাম। আড্ডা দিতাম। সুখ-দুঃখ শেয়ার করতাম। মাঝে আপনি ছিলেন না বাংলাদেশ প্রতিদিনে।
আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত সম্পর্ক আগের মতোই থাকল। পূর্ব-পশ্চিম করলেন আপনি। আপনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম। এমনি একসময় আলমগীর হোসেন ভাই চলে গেলেন বাংলানিউজ ছেড়ে। বললাম, বাংলানিউজের দায়িত্ব নেবেন? জবাবে বললেন, আবার ফিরলে আপনার সঙ্গেই থাকব। বাংলাদেশ প্রতিদিনই আমার ঠিকানা। আপনি আবার ফিরলেন। আমাদের কাজ, আড্ডা বাড়ল আগের মতোই। দুজনের মাঝে আরেকজন ছিলেন, তিনি কামরুল হক শামীম। আমিনুল হক বাদশা, রাশিদুল হক নবা ভাইদের আরেক ভাই। তিনজন ভাই-বন্ধুর মতো চলতাম। দুপুরে খেতাম একসঙ্গে। বাসা থেকে আমাদের খাবার আসত। শামীম ভাই বলতেন, তিনজন মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়ে বেশি। বাকি জীবন কেউ আলাদা করতে পারবে না। আপনি বলতেন, ‘শামীম তোর কথায় বিশ্বাস নেই। তুই আগে আমাদের ছাড়বি।’ করোনা শুরুর আগে শামীম ভাই অসুস্থ হলেন। অফিসে আসা বন্ধ করলেন। তারপর চলে গেলেন কানাডা। দেশে ফিরলেও শামীম ভাই আর কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার অবস্থায় নেই। আপনি বললেন, শামীম আমাদের আগেই ছেড়ে চলে গেল।
করোনার শুরুতে আমি আক্রান্ত হলাম। মনটা এলোমেলো হয়ে গেল। আপনি আশ্বাস দিতেন। ভালো হয়ে আসার পর নুর মোহাম্মদ, কর্নেল (অব.) শাম্মীকে নিয়ে প্রতি শনিবার দুপুরে আমরা খেতে বের হতাম। খাওয়ার বিষয়ে আপনি ছিলেন শৌখিন। মাছ, ভাজি, ভর্তা ছিল প্রিয়। খাবার দিতাম আপনার অর্ডারে। সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবেই করোনার সময় বাঁচতে হবে। প্রতি শনিবার আমরা আড্ডা দেব। দুপুরের খাবার খাব একসঙ্গে। একদিন আড্ডা শেষ করে দুজন অফিসে ফেরার পথে গুলশানে কফি নিতে গিয়ে হাঁটার সময় পেছনের হাড়ে ব্যথা অনুভব করলেন। দুষ্টামি করে বললাম, বুড়ো হচ্ছেন। হাড় ক্ষয় শুরু হয়েছে। কয়েকদিন টানা ব্যথা থাকায় বাসায় বিশ্রাম নিলেন। যোগাযোগ করলেন, ল্যাবএইডের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবের সঙ্গে। মাহবুব ভাইয়ের পরামর্শে ল্যাবএইডে পরীক্ষা করতে গিয়েই জানলেন সেই ভয়াবহ খবর। আপনার শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণ ধরা পড়েছে। হৃদরোগী ছিলেন। কয়েকবার হাসপাতালে ছিলেন। রিং বসানো শরীর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। ক্যান্সারের খবরে মন খারাপ হলো আমাদের। আপনি বললেন, মুম্বাইয়ে যোগাযোগ হয়েছে বিখ্যাত ডাক্তারদের সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। কোনো সমস্যা নেই। সুস্থ হব দ্রুত। মুম্বাই গেলেন দুবার। সঙ্গে ছেলে অন্তর আর ভাতিজা সেন্টু। ভিডিও ফোনে কথা বলতেন প্রতিদিন। আপনার মনোবল দেখে মুগ্ধ হতাম। প্রশংসা করতাম। নুর মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলতেন আরও বেশি। তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতেন। আবার কী গল্প হলো শোনাতেন আমাকে।
ক্যান্সার জয় করে দেশে ফিরলেন। বারবার বললাম অফিসে কম আসবেন। আপনি শক্তিশালী কলামিস্ট। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। যা মনে আসে সাহস করে লেখেন। একজন সাহসী মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের সমাজে সাহসী মানুষ নেই। সমাজের অসংগতি নিয়ে কথা বলার লোক নেই। আপনার শরীর নিয়ে ভাবী ও সন্তানরা চিন্তিত হলেন। দুই ভাই- পীর মতিউর রহমান ও পীর মিসবাহ উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করতেন। অফিসে আপনার সঙ্গে প্রায়ই মেয়েটা আসত। বাবাকে একা ছাড়তে চাইত না। মেয়ের সঙ্গে খুনসুটি করতেন ছেলেকে নিয়ে। ছবি তুলতেন অফিসে বসে। এভাবেই চলছিল। হুট করে একদিন সুনামগঞ্জ গেলেন। বললেন, মন টেনেছে নাড়ির জন্য। নিজেও অনেকবার সুনামগঞ্জ গিয়েছি আপনাদের বাড়ি। বড় ভাই অ্যাডভোকেট পীর মতিউর রহমান ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগ করেন। বড় ভাবী ৩০ পদের রান্না করতেন। মতি ভাই সারাক্ষণ খোঁজ রাখতেন। হাওরে গিয়েছি আমরা বন্ধুরা দলবেঁধে। হাওরে রাত কাটিয়েছি। জোছনারাতে শুনেছি হাছন রাজার গান। আনন্দময় সময়গুলো ছিল আমাদের অন্যরকম। একবার সুনামগঞ্জে গেলাম শ্যালকের জন্য পাত্রী দেখতে। সব আয়োজন করলেন বড় ভাবী আর মিসবাহের স্ত্রী। আপনাদের বাড়ির খাবারের গল্প এখনো হয় আমার শ্বশুরবাড়িতে। আপনি ও আপনার পরিবারকে কখনো আলাদা মনে হয়নি।
জানি এ জীবনটা অনেক ছোট। বারবার অসুস্থ হয়ে আপনি বুঝতে পেরেছেন অনেক আগে। অনেক কথা বলতেন। আক্ষেপ করতেন সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গভীরভাবে লালন করতেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে চলতেন। অন্যায় সহ্য করতেন না। মাঝেমধ্যে বকা দিয়ে বলতাম আপনার এত যুদ্ধের দরকার নেই। নিজের পরিবারের কথা মাথায় রাখবেন। শেষ দিকে আপনিও বলতেন, মেয়েটা এখনো অনেক বেশি ছোট। ছেলেটা পুরোপুরি দাঁড়াতে পারল না। আশ্বস্ত করতাম ছেলে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরেছে। চিন্তার কিছু নেই। মেয়েরা হলো বাবার শেষ বয়সের লাঠি। দেখবেন মেয়ে হুট করে বড় হয়ে গেছে। তারপর আপনার সবকিছু দেখাশোনা করছে। আমাদের অনেক কথা হতো। পারিবারিক, সামাজিক সবকিছু শেয়ার করতাম। ভিতরের দুঃখগুলোও শেয়ার করতাম। আপনি আমার চেয়ে বেশি শেয়ার করতেন। পুরো অফিস হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখতেন। যতক্ষণ অফিসে থাকতেন সবাই বুঝত আপনি আছেন। মাঝেমধ্যে আমার মন খারাপ থাকলে সাহস জোগাতেন। জগৎ-সংসারে আমাদের অনেকে হিংসা করে। ঈর্ষার অনলে পোড়ে। কখনো আমি বলতাম পাত্তা দেবেন না। কখনো আপনি আমাকে বলতেন পাত্তা না দিতে। অসুস্থ হওয়ার পরও আপনার মনোবল কমতে দেখিনি। শেষ দিকে বিয়েসহ কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার খবর শুনে উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করে বকা দিলাম। বললাম এমন করবেন না। দুবার আক্রান্ত হয়ে সামাল দিতে পেরেছি আমি। আপনার এক শ একটা অসুখ। এ ধরনের বাহাদুরির দরকার নেই। জবাবে বললেন, মাস্ক খুলিনি। সাবধান ছিলাম। সাবধানতার পরও কী করে আক্রান্ত হলেন?
হুট করে অফিসে না দেখে ফোন করলাম। বললাম কী অবস্থা। জবাবে বললেন, করোনা হয়েছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আমার মনের অবস্থা বুঝে আপনি বললেন, না, ঠিক হয়ে যাব। ল্যাবএইডে ভর্তি হতে যাচ্ছি। নিয়মিত ফোনে সর্বশেষ খবর জানতাম। আপনি নিজেই সব বলতেন। মাঝে একদিন ফোন করলেন নাসিম ভাই। বললেন, ল্যাবএইডের ডা. শামীমের সঙ্গে কথা হয়েছে। বলেছেন অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। নানা জটিলতা ধরা পড়ছে। তবু একটা আত্মবিশ্বাস ছিল আপনি ভালো হয়ে উঠবেন। দীর্ঘদিন একসঙ্গে পথ চলছি, পীর অসুখকে জয় করতে পারে। এবারও পারবে। আমার ধারণা ঠিক হলো না। আপনি পারলেন না এবার। চলে গেলেন সবাইকে ফেলে। সবাইকে কাঁদিয়ে। পীর এভাবে চলে যাওয়া কি জরুরি ছিল?
কবে কখন কীভাবে আমাদের পরিচয় মনে নেই। তবে আওয়ামী লীগ বিটের সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের ঘনিষ্ঠতা। ভোরের কাগজ ছেড়ে নিউজ মিডিয়া নামের একটি এজেন্সি করেছিলাম। হঠাৎ একদিন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিলাম। তারপর একদিন দেখা হতে বললেন, বাংলাবাজার পত্রিকায় যোগ দিন। আমাকে নিয়ে গেলেন জাকারিয়া খানের কাছে। কাজ করলাম কিছুদিন। তারপর একদিন আমার অনুরোধে বাংলাবাজার পত্রিকা ছাড়লেন পীর হাবিব ও কবি নির্মলেন্দু গুণ। আমরা একসঙ্গে একটি পত্রিকা করার চেষ্টা করলাম। হলো না সেই পত্রিকা। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক থেকে গেল গভীর এক বন্ধুত্বের বন্ধনে। আমি যোগ দিলাম এটিএন বাংলায়। পরে এসটিভি ইউএসে। আমাদের দেখা হতো। আড্ডা হতো। আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসে অনেক সময় ভিন্নমত হতো। কিন্তু কেউ কারও সে মত নিয়ে সম্পর্ক খারাপ করিনি।
পীর হাবিব আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতেন। ক্ষমতাবানদের দাপট ও রক্তচক্ষু পাত্তা দিতেন না। নিজের খেয়ালে চলতেন। সেই চলায় নিজের ক্ষতি হলেও পিছু হটতেন না। একটা লড়াকু ভাব ছিল। দুই হাতে লিখতে পারতেন। তাঁর কলামে কেউ কাঁচি চালালে মেজাজ খারাপ করতেন। আমি হাত চালালে চুপ থাকতেন। পরস্পরের প্রতি একটা সম্মানবোধের সম্পর্ক ছিল। পীরের চলে যাওয়ায় বন্ধুহারা হলাম। ভাইহারা হলাম। সবচেয়ে বড় কষ্টের জায়গাটুকু হচ্ছে, বাইরে থাকার কারণে অংশ নিতে পারলাম না জানাজায়। শুধু আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা- এই মেধাবী, সাহসী, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা কলমযোদ্ধাকে শান্তিতে রাখুন। এ যুগে এ সময়ে তাঁর চলে যাওয়ায় শুধু একটি পরিবার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হলো বাংলাদেশ। এ ক্ষতি পূরণ হবে না কোনো দিন।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।