“শোক হোক শক্তি”

ইবাংলা ডেস্ক

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। কালের পরিক্রমায় আজ ৪৭ বছর পার হয়ে গেলোও ইতিহাস কিংবা স্মৃতি পাতা কোথায় অমলিন হয়ে যায়নি সেই প্রিয় মানুষগুলোর মুখ। এমন বজ্রকন্ঠী,উদ্যম, চিন্তাশীল,যার তেজে অপশক্তির মনে কম্পন সৃষ্টি হতো, যে ব্যক্তি সদা দারিদ্য মানুষের চিন্তায় নিদ্রা বিনাশ করতেন, সেই মানুষকে খুব সহজে রক্তের চাদরে ঢেকে দেওয়া গেলেও তার আদর্শ আর চেতনাকে কখনোই ঢাকতে পারেনি বা ভবিষ্যতেও পারবে না।

স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি পন্থী এক শ্রেণীর লোক কখনো বাংলাকে মেনে নিতে পারেনি। তারা শত চেষ্টার পড় যখন বাঙালিকে দমাতে পারেনি তখন তারা বাঙালির নেতাকে সরিয়ে বাঙালি কে চেয়েছিলো নেতৃত্বহীন এক উম্মাদ দেশে পরিণিত করতে। শুরু হয় কুচক্রী মহলের পরিকল্পনা, ব্যবহার করা হয় আমাদের আমাদের শক্তিকে আমাদের দিকে। ১৯৭১ সালের নির্মম হত্যাকান্ডের পর বাঙালী যখন নিজেদের শোক কাটিয়ে নিজেকে শক্ত করছিলো তখনি সূচনা ঘটে ইতিহাসে আরো একটি জঘন্যতম অধ্যায়ের।

দিনটি ছিলো শুক্রবার। বাঙালি কল্পনা করতে পারেনি,সেইদিন আকাশে সূর্যের আগমনে যেই লাল রঙ্গা আভা দেখা গিয়েছিল তা ছিলো মূলত জনকের আত্মাত্যাগের পরিস্ফুটন। ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি থেকে ফজরের আজানের পর ভেসে আসে গুলির শব্দ, পুরো বাড়ি গ্রাস করে নেই সাদা ধোয়া, বাতাসে সেদিন ভেসেছিলো বারুদের পোড়া গন্ধ,হয়েছিল রক্তের বৃষ্টি। দোসররা তাদের পরিকল্পনা মতো জয়দেবপুর মহড়া শেষে কর্ণেল ফারুকের নেতৃত্বে সবাই এক হয় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে।

আরোও পড়ুন…ওয়েবোমেট্রিক্সের বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩তম জবি

কিছুক্ষণ পর অবসর হওয়া মেজর শরিফুল হক ডালিম ৪০০ সৈন্যর সেই দলকে ৫টি উপদলে ভাগ করে, একটি দলকে মিন্টো রোডের আব্দুর রব সেরনিয়ারাতের বাসায়,আরেকটি দল ১৩/১ ধানমন্ডির শেখ ফজলুল হক মনির বাসায়,তৃতীয় গ্রুপ যায় মেজর ডালিমের নেতৃত্ব শাহবাগ বেতার কেন্দ্রে,আরেকটি দল অবস্থান নেয় কর্ণেল ফারুক এর নেতৃত্বে তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায়,সর্বশেষ গ্রুপকে সবচেয়ে বেশি সৈন্য সহ পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দুইজন মেজরের নেতৃত্বে।

সূচনা হয় আরো একটি কালো রাতের। ঘাতক দল মেতে উঠে হত্যাযজ্ঞে। পাঁচটার দিকে প্রথম আক্রমণ করে আব্দুর সেরনিয়াবাত এর বাসায়।

তারপর সাড়ে পাঁচটার দিকে আক্রমণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর বাসায়। তারা দুইটি বৃত্তকার অবস্থায় বাড়ি ঘেরাও করে। অনেকক্ষণ গুলি করার পর মেজর সহ কিছু সৈন্য বাসার ভিতর ঢুকে পরে। শুরু আবারো হত্যাযজ্ঞ,প্রথমে ব্রাশফায়ারে প্রাণ কেড়ে নেই শেখ কামালের। ঘাতকদল যখন বঙ্গবন্ধুর সম্মুখীন হোন তাকে পদত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু একজন বীরপুরুষ,সংগ্রামী নেতা, যে কিনা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে হার মানেননি সে কিভাবে এই কাপুরুষের দলের কাছে নিজেকে সমার্পন করেন। কথোপকথনের এক পর্যায়ে বজলুল হুদা ও নূর বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে দেয়। ১৮ টি গুলি ছেদ করে যায় জাতির পিতার বুক ও পেট। মূহুর্তের মধ্যে নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ে সিড়িতে। রক্তে ধুয়ে যায় পুরো সিড়ি।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে বেডরুমের বাথরুমে আশ্রয় নেয় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ রাসেল, সুলতানা,কামাল,শেখ জামাল,পারভীন জামাল রোজী,শেখ আবু নাসের। সৈন্যরা তাদের দরজায় গুলি করলে, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে সবাইকে না মারার জন্য অনুরোধ করে। তারা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কে সহ শেখ জামাল,সুলতানা কামাল,রোজিকে মেরে ফলে। রাসেল এবং নাসের ও রমাকে নিয়ে যায় নিচতলায়।

নাসেরকে ঘাতকেরা মারেন সিড়িসংলগ্ন বাথরুমে। রাসেল মহিতুলকে বলে “আমাকে মেরো না ভাই,আমাকে হাসু আপুর কাছে জার্মানীতে পাঠায় দেও।” রাসেলের কথা শুনে মহিতুল মারতে না চাইলেও, আজিজ পাশা তাকে ধরে ফেলে। রাসেল বলে “আমি মায়ের কাছে যাবো”। আজিজের নিদের্শ মতে এক হাবিলদার রাসেলকে তার বাবার লাশের পাশ দিয়ে তার মা, ভাই, ও ভাবির লাশের কছে নিয়ে যাওয়া হয়। সবার রক্তাক্ত মৃত মুখ গুলো দেখার পর তার দিকে ধেয়ে আসে বারুদের দল । শিশু রাসেলের চোখ গুলো বের হয়ে আসে, মাথার পেছনের অংশ থেতলে যায়। সুলতানা কামালের পাশে লুটিয়ে পড়ে তার ছোট্ট দেহ। সেইদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে হয়তো বলেছিলো, আমার কি দোষ ছিলো,,আমি তো আরো কিছু দিন এই বাংলার সতেজ বাতাস প্রশ্বাসে নিতে পারতাম।

কর্ণেল জামিল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে বাচাতে,,খুনীবাহিনীরা তাকে সোবহানবাগ মসজিদের সামনে গুলি করে হত্যা করে। এমনকি বিপথগামী এই সৈন্যরা মিন্টু রোডের বাড়ি কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত,তার মেয়ে বেবি,তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, ৪ বছরের দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহকেও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যাকরে। তাদের এই নরকীয়তা থেকে বাদ যাননি সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, ১৬ বছরের কিশোর আবদুল নইম খান রিন্টুসহ বাড়িতে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজন।

ঠিক একই সময়ে ঘাতকের আরেকটি দল হত্যাকান্ড চলায় যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজুর ওপর। সেইদিন এই হত্যাকান্ডে পরিচারক ও পরিচারিকা,পুলিশ, পাহাড়াদার সহ বহু মানুষ প্রাণ হারায়। মেজর ডালিম বদলে দিতে থাকে সব কিছু, পরিবর্তন হয়ে যায় “জয় বাংলা” শ্লোগান “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ”। রেডিওতে বার বার নতুন সরকার ব্যবস্থা গঠনের ঘোষণা দেয়।

এমনি নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে দিনশেষে খুনীরা লাশগুলো দাফন করার জন্য ৩২নং ধানমন্ডি সড়ক, ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে আনা সবগুলো লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। তীব্র গরমের কারণে লাশগুলোর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের লাশ প্রথম দাফন করা হয়। একে একে সব লাশ দাফন শেষে, তারা ১৬ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে হেলিকপ্টার যোগে চলে যায় টুঙ্গিপাড়া। সেখানে তার চাচাসহ গুটি কয়েকজন মানুষকে নিয়ে জানাযা শেষে দাফন করাহয় মুজিবকে। যার জন্য পুরো বাঙালি জাতি ব্যথিত, তার জানাযায় শরীক হয় মাত্র কয়েকজন।

শুরু হয় আবার নব কূটকৌশল। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন ষড়যন্ত্রকারীরা। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক খুনীদের শাস্তির বদলে জারি করেন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে ঘোষণা দেন। তলিয়ে যেতে থাকে হত্যার বিচার। হত্যাকারীরা বুক ফুলিয়ে নিলর্জের মতো ঘূরে বেড়ায় বাংলায়। তখনি ডুবন্ত নৌকার পাল শক্ত করে ধরেন সূর্যকন্যা শেখহাসিনা। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবারো নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। ১৫ আগস্টকে নবগত জাতির সামনে তুলে ধরতে শোকদিবস হিসেবে পালন করা হয়। নতুন প্রজন্ম জানতে পারেন তাদের প্রিয় নেতার আত্মাত্যাগের কথা।

আরো পড়ুন…১০ টাকা ভাড়া নিয়ে ঝগড়া:চালককে শ্বাসরোধ করে হত্যা, গ্রেফতার ২

কিন্তু ২০০১ সালে চারদলীয় জোট দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে পালন নসাৎ করে দেয়। ঠিক তার পরেই ফখরুদ্দিন আহমেদ ১৫ আগস্ট কে রাষ্ট্রীয় ভাবে শোকদিবস হিসেবে পালন শুরু করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ৫ খুনীকে ফাঁসি দিয়ে শুরু হত্যাবিচার নতুনভাবে। দিবসটি উপলক্ষে শ্রদ্ধা,ভালোবাসা আর গম্ভীরতার সাথে নানারকম কর্মসূচী পালন করা হয়। পতাকা থাকে অর্ধনমিত।সকল প্রতিষ্ঠানে উড়বে কালো পতাকা,যা মনে করিয়ে দেয় ধানমন্ডির ৩২নং বাড়িতে জমে থাকা সেই কালো রক্ত।

১৯৭১ -১৯৭৫, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশকে এই সংগ্রামী নেতা যেই ভিত্তির ওপর দাড় করিয়ে দিয়েছেন,, তাকে হত্যা করতে পারলে এর ভিত্তি নষ্ট করতে পারেনি কেউ। তার একতা, আদর্শ,নেতৃত্ব, দূরদর্শীতা এখনো বাঙালিকে উদ্ভুদ্ধ করে।যেকোনো সংকট মোকাবিলায় তার ৭ মার্চের সেই রক্তে জ্বালাময়ী ভাষণ আজো প্রেরণা যুগায়। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখা সেই সোনার বাংলা আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। এই স্বপ্নের বাংলায় আজও বাজে সেই বাণী,” দমায় রাখতে পারবে না।”দেশ তার আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে, ঝংকার তুলবে শত্রুর মনে। বাঙালি তার এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে ছুটে চলবে তার স্বপ্নের ওপর অবিচল।

লেখকঃ মোঃ রাকিবুল ইসলাম
রসায়ন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইবাংলা/আরএস

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.

Contact Us