মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিপীড়িত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা মহিব উল্লাহকে হত্যার মধ্য দিয়ে কার্যত ওই সম্প্রদায়ের মুখপাত্রকেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে। চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় এর নানামুখী প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তাঁরা হতাশ। এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ পরামর্শক কমিশনের এক বিবৃতিতে এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ইয়াংহি লি বলেছেন, মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার হিসেবে অনেক বছর কাজ করার সূত্রে তিনি মহিব উল্লাহকে ভালো করে চেনেন। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন মহিব উল্লাহ। রোহিঙ্গাদের শান্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামের তিনি ছিলেন সাহসী, অঙ্গীকারবদ্ধ ও অপরিবর্তনীয় এক নেতা।
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধানে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশনের সদস্য মারজুকি দারুসমান বলেছেন, তাঁদের তদন্তে অমূল্য সহযোগিতা করেছিলেন মহিব উল্লাহ। তাঁর প্রচেষ্টায় মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকে জবাবদিহিতে আনার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সমর্থন মিলেছিল।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, জাতিসংঘসহ পশ্চিমা কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে গিয়ে মহিব উল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো আলী রীয়াজের মতে, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেতা মহিব উল্লাহ হত্যা একটি উদ্বেগজনক ঘটনা। যদিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহিংসতার ঘটনা আগেও ঘটেছে, কিন্তু শরণার্থীদের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে আসীন কোনো ব্যক্তিকে হত্যা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’
আলী রীয়াজ তাঁর ফেসবুক পেজে ঘটনা বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড কেবল ক্যাম্পের নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত নয়, এর রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক বেশি। এর প্রতিক্রিয়া হবে বিভিন্ন ধরনের। এতে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ কতটা ক্ষুণ্ন হবে, রোহিঙ্গাদের ভেতরকার শক্তিগুলোর কী ধরনের বিন্যাস ঘটবে এটা যেমন বিবেচ্য, তেমনি বিবেচ্য হচ্ছে এই ঘটনার আগে-পরে রোহিঙ্গাদের বাইরের কোন শক্তি কী ধরনের আচরণ করছে। মহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করা জরুরি। অপরাধীদের শাস্তি প্রাপ্য।’
মহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইইউসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এই হত্যার ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের সবাইকে তাদের অপরাধের জন্য ন্যায়বিচারের মুখোমুখি করা এখন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের ক্যাম্পেইনার সাদ হামাদি বলেন, ‘কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে সহিংসতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে সশস্ত্র মাদক কারবারিরা খুন করছে, জিম্মি করছে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মহিব উল্লাহ হত্যার খবরে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ‘গভীর শোকাহত’ হয়েছেন। তাঁর মুখপাত্র বলেন, ‘শরণার্থীশিবিরে যেন শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে, সে জন্য আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি।’
কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে মহিব উল্লাহ হত্যার নিন্দা জানিয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা অধিকারের কথা বলে, সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলে, মহিব উল্লাহর মৃত্যু তাদের জন্য একটি বড় ধাক্কা।’
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো এক টুইট বার্তায় মহিব উল্লাহ হত্যাকে সহিংস আন্দোলনের বিপরীতে শান্তির বার্তা প্রদানকারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান হামলার দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার টুইট বার্তায় বলেছেন, মহিব উল্লাহ হত্যার খবরে তিনি দুঃখিত ও বিরক্ত।
বাংলাদেশে ইইউ দূতাবাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বার্তায় বলেছে, কর্তৃপক্ষ হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনবে বলে তারা আশা করে।