সরকার বা সরকারের অধীন অন্য কোনো খাতে সবশেষ কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন এমন ব্যক্তিও হতে পারবেন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। এমন বিধান রেখে বিমা কোম্পানির ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ’ প্রবিধানমালা সংশোধনের খসড়া তৈরি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এমন বিধান রেখে প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করা হলে বিমা খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বিমা খুবই টেকনিক্যাল বিষয়। যে কারণে একটি বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিতেই দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। একজন সিইওকে প্রশাসন থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের খুঁটিনাটি বিষয় জানতে হয়। সেখানে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে বসিয়ে দিলে বিমার সাধারণ বিষয় বুঝতেই তার কয়েক বছর চলে যাবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুট করে কাদের স্বার্থে এমন পরিবর্তনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে সেটি দেখতে হবে। এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে বিমা খাতের কোনো উন্নয়ন হবে না, বরং এ খাত আরও পিছিয়ে যাবে। এমনিতেই দেশের বিমা খাত অনেক অবহেলিত এবং বিমার সম্পর্কে মানুষের পজিটিভ ধারণা খুব কম। তাই বিমা খাতের উন্নয়নের স্বার্থে বিমা বিষয়ে ভালো অভিজ্ঞতা থাকা ব্যক্তিকেই সিইও হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা উচিত।
আইডিআরএ’র দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বিমা খাতে দক্ষ জনবলের অভাব থাকায় যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সিইও হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে খসড়া প্রবিধানমালায়। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর এটি হলেই যে যুগ্ম-সচিবরা বিমা কোম্পানির সিইও হয়ে যাবেন তা নয়। কারণ কাকে সিইও নিয়োগ দেওয়া হবে, সেটি বিমা কোম্পানি থেকেই বাছাই করা হয়। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আপত্তি উঠলে এ বিধান বাতিল করা হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বিমা খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেই।
আরও পড়ুন…নওয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধে স্ত্রীর অভিযোগ
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিমা কোম্পানির ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২’ এর সংশোধনী খসড়া সম্প্রতি তৈরি করে বিমা খাত সংশ্লিষ্টদের মতামত চেয়েছে আইডিআরএ। এ খসড়া প্রবিধানমালায় বিমা কোম্পানির সিইও’র শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বিমা কোম্পানির সিইও’র শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে খসড়া প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রির অধিকারী হতে হবে। গ্রেডিং পদ্ধতির ফলাফলের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। তবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী হলে দাখিল করতে হবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে সমতাকরণ সার্টিফিকেট।
আর কর্ম অভিজ্ঞতার বিষয়ে খসড়া প্রবিধামালায় বলা হয়েছে, এর আগে কোনো বিমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বা এর অব্যবহিত নিম্নপদে কমপক্ষে দুই বছর কর্ম অভিজ্ঞতাসহ বিমা ব্যবসায় কমপক্ষে ১২ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকবে হবে।
এক্ষেত্রে তবে দিয়ে দুটি বিধান তৈরি করা হয়েছে। এর প্রথমটি হলো- কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত মনে করলে শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘সরকার বা সরকারের অধীন অন্য কোনো খাতে সবশেষ কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার পদে কর্মরত ছিলেন এমন ব্যক্তি যার ব্যাংক/বিমা/আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছরের (তার মধ্যে বিমা বিষয়ক কাজে কমপক্ষে এক বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা) কর্ম অভিজ্ঞতাসহ সরকারি কাজে কমপক্ষে ১৫ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা রয়েছে তার নিয়োগ অনুমোদন করতে পারবে।’
আরও পড়ুন…সর্বোচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও আদেশ প্রদান
আর দ্বিতীয়টি হলো ‘আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বহুজাতিক বিমা কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা পদে কমপক্ষে আট বছরের বিমা বিষয়ক সরাসরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকেও দেশের বিমা কোম্পানির সিইও নিয়োগ দেওয়া যাবে’। এক্ষেত্রেও আইডিআরএ উপযুক্ত মনে করলে শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সিইও নিয়োগ অনুমোদন করতে পারবে।
বর্তমানে কার্যকর থাকা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২ অনুযায়ী, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রিও গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ, স্নাতকের ফলাফলের বিষয়ে কোনো সীমা নির্ধারণ ছিল না। এমনকি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়েও কোনো বক্তব্য ছিল না। এই প্রবিধানমালায় বিমা কোম্পানির সিইও’র শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে তিন বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি।
কর্ম অভিজ্ঞতার শর্তে রাখা হয়েছে, একই শ্রেণির বিমা কোম্পানিতে ১৫ বছরে চাকরির অভিজ্ঞতাসহ সিইও অব্যবহিত নিম্নপদে তিন বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অর্থাৎ, কোনো জীবন বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে জীবন বিমা কোম্পানিতেই কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একইভাবে সাধারণ বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে সাধারণ বিমা কোম্পানিতেই থাকতে হবে কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা। তবে বিমা বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের জন্য অভিজ্ঞতা শর্তসাপেক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিথিল করার বিধান রাখা আছে। আর বয়সের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৪০ থেকে ৬৭ বছরের মধ্যে।
আরও পড়ুন…দরিদ্ররা বঞ্চিত, কাদের জন্য এ বাজেট: মমতা
সংশোধিত খসড়া প্রবিধানমালাতেও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বয়সের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৪০ থেকে ৬৭ বছর। তবে বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি বিমা কোম্পানির সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের নাগরিক বা বাংলাদেশের ডমিসাইল’ হওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে।
একটি বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, যারা বিমা খাতের কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে সিইও হতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লাগবে। অন্যদিকে যুগ্ম-সচিব পদমর্যদায় যারা এক বছর বিমা সম্পর্কে কাজ করেছেন তারাও সিইও হতে পারবেন। তাহলে কি আল্লাহতালা নিজে যুগ্মসচিবদের ব্রেনে বিমা বসিয়ে দিয়েছে, যে তারা এক বছর কাজ করেই সবকিছু পারবেন।
যোগাযোগ করা হলে প্রগতি লাইফের সিইও মো. জালালুল আজিম বলেন, কার স্বার্থে এই পরিবর্তন হচ্ছে? যারা বিমা কোম্পানির সিইও হয় তাদের এত বছরের অভিজ্ঞতা লাগে। দ্বিতীয় পজিশনের অভিজ্ঞতা লাগে। এই অভিজ্ঞতাগুলো কেন, যাতে আমরা এই বিভাগের যাবতীয় কাজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানি। এ ধরনের একজন লোককেই তো সিইও হওয়ার বিধান করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন…বিএনপি হত্যা ও মিথ্যাচারের উপর সৃষ্টি হয়েছে: শেখ পরশ
‘সেখানে একজন যুগ্ম-সচিব, যিনি এক বছর কাজ করবেন বিমা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে, ধরে নিলাম যারা আইডিআরএ-তে কাজ করেন তাদের জন্য এটা করা হচ্ছে। এক বছরেও তো ওনারা শুধু বিমার আইন-কানুন সম্পর্কেই কাজ করেন। তারা তো ব্যবসা উন্নয়নের কোনো কাজ করেন না, আন্ডাররাইটিং করেন না, ক্লেম সেটেলমেন্ট করেন না। তাহলে শুধু আইনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একজনকে সিইও বানাবে, এটা কতটা যুক্তিসঙ্গত?’
বিমা খাতে দক্ষ জনবেলের অভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের বিষয়ে খসড়া প্রবিধানে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সেটা হলো- আগে ছিল ১৫ বছরের কাজ করার অভিজ্ঞতা, এখন সেটা ১২ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পজিশন তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর করা হয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে একটা বাধা ছিল চার বছরের স্নাতকসহ, সেটা সংশোধন করা হলো। তাহলে তো লোক পাবেন।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বলেন, যুগ্ম-সচিবদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার যে সুযোগ খসড়া প্রবিধানে দেওয়া হয়েছে, সেটা চূড়ান্ত করা হলে বিমা খাত ড্যামেজ হবে। সেই ড্যামেজ সরকারের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে এবং অর্থনীতির ওপর আঘাত হানবে। এটা কীসের মাধ্যমে এলো বুঝলাম না। এ পলিসিটা কীভাবে হয়। এটা হয় নাকি? তাহলে তো ব্যাংকেও হতে পারে। কিন্তু ব্যাংকে তো হয় না।
আরও পড়ুন…বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের রপ্তানি সহায়ক প্রাক অর্থায়ন তহবিল গ্রহণের মুদারাবা চুক্তি
তিনি বলেন, বিমা খাত অনেক বেশি টেকনিক্যাল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেখানে বিমা খাতকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, এরা এখানে এটা পেছায়। এর কারণ হচ্ছে আইডিআরএ চালায় তো মূলত অন ডেপুটেশন, এখানে স্টাফ আগে বেতনভুক্ত ছিল না। তাদের কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। আর এখানে বড় অফিসার যারা ছিল সবই অন ডেপুটেশনে গভর্নমেন্টের লোক। গভর্নমেন্টের লোক তারা দেখলো যে, আইনটা পাস করতে পারলে সিইও হবে। সাধারণ বিমা করপোরেশন, জীবন বিমা করপোরেশন ভিন্ন, এরা সরকারি সুবিধা নিয়ে চলে। এখানে হতে পারে। তাই বলে বিমাতে আসতে পারে, আমি মনে করি এটা উচিত হবে না।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের পরিবর্তন আনছে, এটার খসড়া আইডিআরএ আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা আমাদের মতামত দেবো। আমি মনে করি এটা হওয়া উচিত নয়। এটা হলে তা এই খাতের জন্য ব্লান্ডার হিসেবে পরিগণিত হবে এবং অর্থনীতিতে একটা আঘাত আসবে।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, আমরা খসড়া করে সেক্টর থেকে মন্তব্যের জন্য পাঠিয়েছি। বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য দিলে তারপর তাদের নিয়ে মিটিং করবো। তারপর চূড়ান্ত করবো। প্রবিধানে যাই রাখা হয়েছে, তা চূড়ান্ত নয়।
আরও পড়ুন…ইবি প্রশাসনের চার পদে পরিবর্তন ও তিন পদে পুনঃনিয়োগ
যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ রাখার কারণ কী? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা যাই রাখি, নিয়োগ তো দেবে কোম্পানি। কতগুলো বিমা কোম্পানিতে সিইও পদ খালি আছে, আপনারা দেখেন না। যোগ্য লোক থাকলে কি এ পদ খালি থাকে। তবে যাই হোক সংশোধনী এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদি খাত সংশ্লিষ্টরা এবং সরকার রাজি না হয়, এটা আমরা করবো না।
ইবাংলা/ জেএন/ ২ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.