সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলঙ্কজনক অধ্যায়। এরপর দ্বিতীয়টি ছিল ৩ নভেম্বর জেলহত্যা। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার ও রায় কার্যকর করলেও ১০ খুনি আজও অধরা। নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যাকারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন : শোকাবহ জেল হত্যা দিবস আজ
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী খোন্দকার মোশতাক কারাগারে বন্দি করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং খাদ্য ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।
৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে রাতের আঁধারে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের চারজনকেই। জেল হত্যার পরদিন তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। তবে দীর্ঘ ২১ বছর এই বিচারের প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে।
ঘটনার ২৯ বছর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত জেলহত্যা মামলার রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ, আহমদ শরিফুল হোসেন, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন। অন্যদিকে সাবেক মন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়।
আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী
২০০৮ সালে হাইকোর্ট রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, কিন্তু মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেন। খালাস দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া কুখ্যাত খুনি ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকেও। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেয়া তিনজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনি কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), মেজর (অব.) এ কে বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি) ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি। সর্বশেষ গত বছরের ১২ এপ্রিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় খুনি আবদুল মাজেদের।
আরও পড়ুন : গণতন্ত্রের মানসপুত্র ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
পলাতক ১০ আসামি, তিন খুনির তথ্য নেই সরকারের কাছে। এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে খুনিরা। দণ্ডিত ১০ আসামির সবাই পলাতক, যাদের তিনজন মৃত্যুদণ্ড ও সাতজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত। পলাতকরা হলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোসলেম উদ্দিন, মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসার।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও জেলহত্যার খুনিরা একই। এরই মধ্যে অন্য মামলায় ছয় আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। পলাতক আসামিরা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। এদের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ইবাংলা/এএমখান/০৩ নভেম্বর, ২০২১