সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্নকে সঙ্গী করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে উড়াল দিয়েছিল বাংলাদেশ। নিজেদের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাসের পারদের উচ্চতাও বেশ বাড়িয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্নের সিংহাসন যে এভাবে হুড়মুড় করে খানখান হয়ে যাবে তাই বা কে ভেবেছিল?
অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে হারানোর জ্বলজ্বলে স্মৃতি নিয়েই বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি ও ওমান ছিল বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ। সুপার টুয়েলভে খেলতে অন্তত দুটো জয়ের দরকার ছিল। যদিও বাংলাদেশ তিনটি ম্যাচেই জয়ের প্রত্যাশা করেছিল। শুধু তাই নয়, প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের সামনে প্রতিপক্ষরা একপ্রকার উড়েই যাবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং দুই জয়ে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের মিশন। পরে পাপুয়া নিউগিনি ও ওমানের সঙ্গে জয় পায় তারা।
সুপার টুয়েলভে উঠলেও টাইগাররা সমর্থকদের মন জয় করতে পারেনি। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তো হেরেছিল। আর অখ্যাত ওমানের বিপক্ষে জয় ছিল মাত্র ২৬ রানে। যা হোক, বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে সুপার টুয়েলভে। একের পর এক হেরেছে। এক ম্যাচ হারের পর পরের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশায় আবার বুক বেঁধেছে। কিন্তু তা হয়নি। শুধু তাই নয়, লজ্জায়ও ডুবতে হয়েছে। দুই ম্যাচে দলীয় স্কোরকে বাংলাদেশের ব্যাটাররা তিন অংকে নিতে পারেনি। চতুর্থ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র ৮৪ রানে হেরেছিল। তারপরও বাংলাদেশের সমর্থকেরা আশা ছাড়েনি। এ লজ্জাকে পেছনে ফেলার জন্য বাংলাদেশের সমর্থকেরা শেষ ম্যাচের অপেক্ষায় ছিল।
ভাবনায় ছিল অস্ট্রেলিয়াকে দেশের মাটিতে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে না। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে কিছুটা হলেও সম্মান নিয়ে দেশে ফেরা যাবে। কিন্তু কোথায় কি? এবার আরও বেশি লজ্জায় ডুবতে হলো। শুধু তাই নয়, লজ্জার ওপর লজ্জার এসে পড়ল। মাত্র ৭৩ রানে অল আউট। আর একটু হলেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজেদের সর্বনিম্ন স্কোর ঢাকা পড়ে যেত। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন স্কোর ৭০। ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এ রান করেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে লজ্জার শেষ এখনও হয়নি। ম্যাচে ন্যূনতম প্রতিরোধও গড়তে পারেনি। এ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটাররা বাংলাদেশের বোলারদের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছে। মাত্র ৬.৩ ওভারে তারা জয় তুলে নেয়। বিশ্ব ক্রিকেটে কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে কোনো দল এত কম বল খেলে কখনও জয়ের দেখা পায়নি। সবচেয়ে কম বলে জয়ের রেকর্ড ৩.২ ওভারে। তুরস্কের বিপক্ষে ৩৩ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে অস্ট্রিয়া জয় পেয়েছিল।
টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে এমন লজ্জার দ্বিতীয় কীর্তিও বাংলাদেশের। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ড ৭০ বল হাতে রেখে ১০ উইকেটে জয় পেয়েছিল। হ্যামিল্টনে অনুষ্ঠিত নিউজিল্যান্ডের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৯ রান।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যেন ‘লজ্জার রেকর্ড’ করতেই গিয়েছিল বাংলাদেশ। চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই ‘হৃদয়বিদারক’ ঘটনাগুলো-
১। ১৭ অক্টোবর, ২০২১; ভেন্যু: আল আমেরাত ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, ওমান
স্কটল্যান্ড: ১৪০/৯ (২০), বাংলাদেশ: ১৩৪/৭ (২০);
ফল: স্কটল্যান্ড ৬ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: ক্রিস গ্রিভস (২৮ বলে ৪৫, ১৯ রানে ২ উইকেট)
বাংলাদেশের টুর্নামেন্টটা শুরুই হয়েছিল হোঁচট খেয়ে। ওমানের আল-আমেরাত অ্যাকাডেমিতে টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
সাকিব আল হাসান (৪-০-১৭-২) ও শেখ মেহেদির (৪-০-১৯-৩) ঘূর্ণিতে দম বন্ধ হওয়া শুরু করে স্কটিশদের ‘দমবন্ধ’ হওয়া শুরু করে। এমন মুহূর্তে স্কটিশদের ‘অক্সিজেন’ হিসেবে কাজ করেন ক্রিস গ্রিভস।
৪ চার ও ২ ছক্কায় গ্রিভসের ২৮ বলে ৪৫ রানের ইনিংসে স্কটিশরা করে ১৪০ রান। ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়েও দুর্দান্ত ছিলেন গ্রিভস (৩-০-১৯-২)। যেখানে স্কটিশ অলরাউন্ডারের উইকেট দুটো ছিল সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমের। ইনিংসের শেষ ওভারে মাহেদি ছক্কা-চার হাঁকালেও তা শুধু ব্যবধানই কমাতে পেরেছে। বাংলাদেশ হেরে যায় ৬ রানে।
২। ২৯ অক্টোবর, ২০২১; ভেন্যু: শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাত
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৪৩/৭ (২০), বাংলাদেশ: ১৩৯/৭ (২০)
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: নিকোলাস পুরান (২২ বলে ৪০)
স্কটল্যান্ড ম্যাচের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশ ঘটিয়েছিল সুপার টুয়েলভে। এবারের ঘটনা ঘটেছিল ওমানের প্রতিবেশি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
শারজায় সুপার টুয়েলভে ‘বাঁচা-মরার ম্যাচে’ টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। একদিকে বোলাররা যেমন উইন্ডিজ ব্যাটারদের টুঁটি চেপে ধরেছিলেন, অন্যদিকে একের পর এক ক্যাচ মিসে তা ‘পরিশোধ’ করে দিচ্ছিলেন বাংলাদেশি ফিল্ডাররা।
নিকোলাস পুরান (২২ বলে ৪০) ও জেসন হোল্ডারের (৫ বোলে ১৫*) ক্যামিও ইনিংসে উইন্ডিজ সংগ্রহ করে ৭ উইকেটে ১৪৩ রান। ১৪৪ রানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাচ্ছিল ঠিকই।
তবে আশা জাগাচ্ছিলেন লিটন দাস (৪৩ বলে ৪৪) ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (২৪ বলে ৩১)। ৭ বলে ১৪ রান, এমন মুহূর্তে ডোয়াইন ব্রাভোকে লং-অন দিয়ে ছক্কা মেরে নিজের ফিফটি ও দলকে আরও একটু এগিয়ে নিতে গিয়েছিলেন।
তবে বাধ সাধলেন ৬ ফুট উচ্চতার হোল্ডার। ইনিংসের শেষ বলে আন্দ্রে রাসেলকে চার মেরে উইনিং রান নিতে গিয়েছিলেন রিয়াদ। তবে ঠিকঠাক সংযোগ না হওয়ায় আরও একবার ‘তীরে এসে তরী ডোবার’ আক্ষেপে পোড়ে বাংলাদেশ।
৩। ২ নভেম্বর, ২০২১; ভেন্যু: শেখ জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত
বাংলাদেশ: ৮৪/১০ (১৮.২), দক্ষিণ আফ্রিকা: ৮৬/৪ (১৩.৩)
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ৬ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: কাগিসো রাবাদা (২০ রানে ৩ উইকেট)
আগের দুবারের রেকর্ডটি থেকে এই রেকর্ডটি আলাদা, আর ভেন্যুও আলাদা। এবারের ‘লজ্জার রেকর্ডটি’ছিল ১০০ এর নিচে অলআউট হওয়ার।
আবুধাবিতে এবার দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছিল বাংলাদেশ। দুই প্রোটিয়া পেসার কাগিসো রাবাদা (৪-০-২০-৩) ও এনরিখ নরকিয়ার (৩.২-০-৮-৩) দুর্দান্ত বোলিংয়ে ঠকঠক করে হাঁটু কাঁপতে থাকে বাংলাদেশি ব্যাটারদের। ১০ বল হাতে রেখে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ৮৪ রানে।
৮৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৩ রানেই ৩ উইকেট হারায় প্রোটিয়ারা। যেখানে দুটো উইকেট নিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ (৪-০-১৮-২)।
তাতে শুধু প্রোটিয়াদের জয়ই বিলম্বিত হয়েছে। ১৪ তম ওভারের তৃতীয় বলে শেখ মাহেদিকে মিড উইকেট দিয়ে চার মেরে ৬ উইকেটের বিশাল জয় এনে দেন ডেভিড মিলার।
৪। ৪ নভেম্বর, ২০২১; ভেন্যু: দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাত
বাংলাদেশ: ৭৩/১০ (১৫), অস্ট্রেলিয়া: ৭৮/২ (৬.২)
ফল: অস্ট্রেলিয়া উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: অ্যাডাম জাম্পা (১৯ রানে ৫ উইকেট)
কথায় আছে‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’- এটা ভেবে বাংলাদেশি ভক্তরা অন্তত একটি জয়ের প্রত্যাশা করেছিল। হলো না সেটাও!
ইবাংলা/এএমখান/০৪ নভেম্বর, ২০২১