বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যুগান্ত সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্তের প্রয়াণ দিবস আজ মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর)। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রকার ২০১২ সালের এই দিনে ৮২ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। কৃতী এই চলচ্চিত্রকারের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সুভাষ দত্তের জন্ম ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায় মামার বাড়িতে। পৈত্রিক বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার চকরতি গ্রামে। তার বাবার নাম প্রভাষ চন্দ্র দত্ত ও মায়ের নাম প্রফুল্ল নলিনী দত্ত। ২ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার ২ ছেলে শিবাজী দত্ত ও রানাজী দত্ত এবং ২ মেয়ে শিল্পী দাস ও শতাব্দী মজুমদার। স্ত্রী সীমা দত্ত ২০০১ সালের অক্টোবরে প্রয়াত হন। শেষ দিন পর্যন্ত ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম কর্ণধার ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত। আজীবন ধরে চলচ্চিত্রের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন খ্যাতনামা এই ব্যক্তি। ছিমছাম, গোছানো ব্যক্তিত্ব নিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন ছোটবেলা থেকে দুরন্তপনা আর সৃজনশীলতাকে সঙ্গী করে। তিনি খুব অল্প বয়সে সাধারণ থেকে কিছুটা ভিন্ন জীবনের পথে পা বাড়ান।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী ও অভিনেতা সুভাষ দত্ত দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইএসসি পাস করে ভারতের বোম্বেতে চলে যান এবং সেখানে কমার্শিয়াল আর্ট শেখেন ও বোম্বের চলচ্চিত্রাঙ্গনের সঙ্গে পরিচিত হন।
ঢাকায় ফিরে ১৯৫৬ সালে এভারগ্রিন পাবলিসিটি নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দেন। ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পোস্টার ডিজাইনার হিসেবে।
১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। এরপর কয়েকটি চলচ্চিত্রে কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করে প্রশংসা পান। ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রে শিল্প নির্দেশনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যান। সুভাষ দত্ত পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’ ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে চিত্রনায়িকা কবরীর অভিষেক ঘটে। এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করে।
১৯৬৮ সালে ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মাণ করেন ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। ১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘২৩ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ নামে তিনি যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন,তা আজও চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত।
১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি সেরা পরিচালক ও প্রযোজকসহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া সুভাষ দত্ত পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে কাগজের নৌকা, আয়না ও অবশিষ্ট, আবির্ভাব, বলাকা মন, সবুজ সাথী, পালাবদল, আলিঙ্গন, বিনিময়, আকাক্সক্ষা, সকাল সন্ধ্যা, ডুমুরের ফুল ইত্যাদি। সুভাষ দত্ত একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন এবং এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছেন।
এছাড়া ১৯৭২ সালে ঢাকার আরণ্যক নাট্যদলের প্রথম প্রযোজনা ‘কবর’ নাটকে প্রথমবারের মতো মঞ্চাভিনয় করেছিলেন তিনি। শ্রেষ্ঠ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তার মধ্যে আছে ফ্রাঙ্কফুট চলচ্চিত্র উৎসবে
কবরী দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবি পুরস্কার ১৯৬৫ সাল, পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতা ১৯৬৫ সাল, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার ১৯৬৭ সাল, কম্বোডিয়া নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে কম্বোডিয়ার রানীর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কার সার্টিফিকেট অফ ম্যারিট ১৯৬৯ সাল, মস্কো চলচ্চিত উৎসব পুরস্কার ১৯৭৩ সাল, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক ১৯৭৭ সাল, বাচসস পুরস্কার শ্রেষ্ঠ প্রযোজক ও পরিচালক ১৯৭৯ সাল, প্রযোজক সমিতির পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ কস্টিউম ডিজাইনার ও একুশ পদকপ্রাপ্ত ১৯৯৯ সাল। এছাড়া বহু ক্রেস্ট পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। তার মধ্যে সাংস্কৃতিক জোটের বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, জহির রায়হান পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। তার মধ্যে সাংস্কৃতিক জোটের বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, জহির রায়হান পুরস্কার, আব্দুল জব্বার খান স্মৃতি পুরস্কার, আই.ডি.ই এবং এস.এম পারভেজ পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার ২০৩, গীতাঞ্জলী সম্মাননা পদক ২০০৪, শেলটেক পুরস্কার ২০০৫, টি.ডি পুরস্কার ২০০৬, শেরে বাংলা পুরস্কার ২০০৭, জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল ফোরাম পুরস্কার ২০০৭, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনি শেরে বাংলা ফজলুল হক স্বর্ণপদক ২০০৭ (চলচ্চিত্রে অবদান), লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০০৭, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আয়োজন জার্নালিম ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ওয়ারিদ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার ২০০৭, ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার ২০০৭ (শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা), বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অনন্যা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আজীবন সম্মাননা ২০০৭, লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পদক ২০০৮, বাংলাদেশ হিন্দু ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম ২০০৮, ফোকাস বাংলাদেশ শাইনিং পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড, বীরশ্রেষ্ট রুহুল আমীন স্বাধীনতা স্বর্ণপদক ২০০৮ খুলনা, আলোড়ন সাৃতিহ্য সাংস্কৃতিক সংসদ পুরস্কার ২০০৮।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সুভাষ দত্ত ১৯৯৯ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন সুভাষ দত্ত।
ইবাংলা/এএমখান/১৬ নভেম্বর, ২০২১