চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক
মুক্তা মাহমুদ
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি হলো গণপ্রজাতান্ত্রিক চীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলো সিপিসি বা চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে চীনের গৃহযুদ্ধে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কুওমিনতাঙকে পরাভূত করে চীনের মূল ভূখণ্ডে ক্ষমতাসীন হয় দলটি।
১৯২১ সালে শাংহাইয়ের ফরাসি উপনিবেশে একটি অনানুষ্ঠানিক সংগঠন হিসেবে চেন দুজিউ এবং লি দাজাও কর্তৃক প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রথম পার্টি কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে।
সাংহাইতে আয়োজিত দলের প্রথম এই কংগ্রেসে সভ্য ছিলেন মোট ৫৩ জন। এই সময়ই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নামকরণ করা হয় ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টি’। পার্টির প্রতিষ্ঠায় যে সকল নেতৃবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন লি দাজাও, চেন দুজিউ, চেন গংবো, তাং পিংশান, জাং গুওতাও, হে মেংজিয়ং, লউ জাংলং এবং দেং জংজিয়া।
প্রথম পার্টি কংগ্রেসে দলের পরবর্তীকালের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাও সে তুং ছিলেন হুনান কমিউনিস্ট গোষ্ঠী থেকে দু’জন সভ্যের মধ্যে একজন হিসেবে সে দিন উপস্থিত ছিলেন। করোনা মহামারির পরিবর্তিত এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই দলটি চলতি বছর জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে।
চীনের বর্তমান অগ্রযাত্রার মূল কারিগরই হলো এই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসি। পেছনের ইতিহাস বলে, ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়।
তার আগে চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকারের আমলে চীন ছিল দারিদ্র্য-পীড়িত একটি দেশ। অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নাজুক। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৪৯ সালে চীনের ক্ষমতা আসে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে।
শুরু হয় চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা। বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং বিদেশী বিনিয়োগ টানতে গত শতকের ৭০ দশকের শেষের দিকে দেশের অর্থনীতি ও শিল্পায়ন নীতিতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি।
যেখানে চীন এখন বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। সেই সময়ই চীন তার আভ্যন্তরীণ বাজার উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর সুফলও দ্রুতই পায় দেশটি। চীনের অর্থনীতিতে ১৯৮০-৯৫ সাল পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়।
পরবর্তী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন চীনে প্রবৃদ্ধি ১১ থেকে ১৩ শতাংশও হয়েছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর। বর্তমানে শি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও তা প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনোমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ-সিইবিআর এর তথ্যমতে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা এবং প্রবৃদ্ধির চলমান গতি অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসি শাসিত চীন ২০২৮ সাল নাগাদ বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।
চীনের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে ধারাবাহিক কমিউনিস্ট সরকারগুলোর বিভিন্ন অঞ্চল ও মানুষের মধ্যে আয়ের অসমতা দূর করার প্রচেষ্টা এবং শহর ও গ্রামাঞ্চল, উন্নত ও অনুন্নত এলাকা এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করার তৎপরতার কারণে।
সামরিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলেছে চীন। বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যে ভাগ বসিয়েছে দেশটি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্বার গতিতে বিশ্বে এগিয়ে চলেছে।
দেশটিই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে টেকসইভাবে সবার আগে করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। যা সম্ভব হয়েছে সিপিসির কারণেই। যদিও চীনের উহানের স্থানীয় একটি বাজারে ২০১৯ সালে করোনার উৎপত্তি।
তারপরও দেশটির সরকারের কার্যকর নেতৃত্বের কারণেই করোনা মহামারি রোধ সম্ভব হয়েছে দেশটিতে। আর করোনার পর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে শি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কোম্পানিগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে এবং রাজস্ব প্রণোদনা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলেছে, চলতি বছর চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি বলছে প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৭ শতাংশ। প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও ত্বরিত গঠনমূলক পদক্ষেপের কারণেই বিশ্বব্যাপী করোনা মোকাবেলায় দেশটি সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এরই মধ্যে দেশটির সিনোভ্যাকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান করোনা প্রতিরোধী টিকা আবিষ্কার করেছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেতে বেশ কাঠখড়ই পোড়াতে হলো দেশটিকে।
গেল ৩ জুন বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনার সংক্রমণে শীর্ষ দেশ ব্রাজিলের একটি শহরে সিনোভ্যাকের টিকা দেয়ার পর সেখানে মৃতের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমে গেছে। এ তথ্যই প্রমাণ করে চীনের সিনোভ্যাক ও অন্যান্য টিকা বেশ কার্যকরী।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৬০টির অধিক দেশে চীনের টিকা সফলতার সাথে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনা মোকাবেলাই এ মুহূর্তে চীনা সরকার তথা ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান লক্ষ্য।গত মার্চে অনুষ্ঠিত ধনী দেশগুলোর সংস্থা জি-২০’র সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং চারটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
সেগুলো হলো- যেসব দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয় তাদের সহায়তা করা ও করোনা সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়; সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার জন্য একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালনে সহায়তা এবং করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যাতে মন্দার মধ্যে না পড়ে সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া।
সিপিসির সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্ট শির এই প্রস্তাবের মধ্যেই তার এবং তার দলের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ফুটে ওঠে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়াও বৈশ্বিক করোনা মোকাবেলায় নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে চীন।
এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশকে নিয়ে ইমারজেন্সি কোভিড ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি গঠনের প্রস্তাব দেয় চীন সরকার। বাংলাদেশ এতে সম্মতি জানায়। চীন শুধু নিজ দেশেই নয় বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের করোনা মোকাবেলায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
করোনা কারে চীনের এই সহায়তার কথায় পরে আসি। এর আগে দু’দেশের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক তথা কূটনৈতিক সম্পর্কগুলো এক নজরে জানা যাক।
বাংলাদেশ চীন সম্পর্ক :
বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী বা চীনের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক নতুন নয় বহু প্রাচীন এ বন্ধুত্ব। বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল যে পথ তার নাম রেশম পথ, যা সিল্ক রোড নামে ইতিহাসে বিখ্যাত। চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই সমুদ্র উপকূলীয় দেশ বিধায় সমুদ্রপথে তাদের মধ্যকার আদান-প্রদান ছিল চমৎকার সেই প্রাচীন থেকেই।
প্রাচীনকাল থেকে চীন নৌ ও স্থলশক্তিতে অত্যন্ত বলবান দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীন অন্য কোনো দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেনি, অন্য কোনো দেশ দখল করে নেয়নি। বরং সব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এসেছে। যে কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে ১৯৭৫ সালে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমেই তা আরও নিবিড় হয়েছে এবং এই সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিন্নতা সত্ত্বেও এই দুই দেশের মধ্যকার চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও চীন সহযোগিতা করে এসেছে।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান আঞ্চলিক কৌশলগত ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক কৌশলগত ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ-সেতু হিসেবে বিবেচিত। এশিয়ার দুই বৃহৎ দেশের মধ্যখানে বাংলাদেশের অবস্থান, যার একটি উদীয়মান ভারত। অন্যটি চীন, যা ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের একটি শক্তিশালী অংশীদার ভারত; দেশটি বঙ্গোপসাগরকে নিজের হ্রদ হিসেবে বিবেচনা করে এবং আসিয়ানের ব্যাপারে তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগসমূহের জন্য একটি সামুদ্রিক জলসীমা বলে মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্রও একটি প্রধান অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত; যার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের প্রধান খুঁটিই হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র তার নৌ-শক্তির ৬০ শতাংশই প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ মনে করে চীন একটি বিনম্র শক্তি; দেশটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং শান্তির পথই অনুসরণ করে। তবে চীন তার সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ এবং সে অনুসারেই নিজের নৌ-শক্তি গড়ে তুলেছে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতিরক্ষা। ২০০২ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেটি একটি সাধারণ সামগ্রিক চুক্তি, যার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ, সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ অভিযান, লজিস্টিক লাইনসমূহ উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ দমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সম্ভাব্য ক্ষেত্র।
আমাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর আধুনিকায়ন ও শক্তিশালীকরণ প্রয়োজন; হালনাগাদকরণের মাধ্যমে সময়োপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) ও সম্প্রসারিত মহী-সোপানের নিরাপত্তা এবং সমুদ্রতলের মূল্যবান হাইড্রো-কার্বনসহ আমাদের সামুদ্রিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ উল্লেখিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় চীনের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা চায়।
এ লক্ষ্য সামনে রেখেই বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীকে সমুদ্রপৃষ্ঠে যুদ্ধ করার উপযোগী নৌ-বহর, সমুদ্রতলে সাবমেরিন এবং আকাশে নৌ-বাহিনীর নিজস্ব জঙ্গি বিমানে সুসজ্জিত করে তোলার ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে চীন সফর করেন এবং একই বছর চীনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে পরিপূর্ণ আশ্বাস ব্যক্ত করে চীন সরকার।
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সর্বতোমুখী সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সমুদ্রপথে দু’দেশের যোগাযোগ উন্নত ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন; সে জন্য চীনের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের দিকে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা জরুরি।
মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম ও কুনমিংয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক ও রেল যোগাযোগও গড়ে তুলতে চায়। এর মধ্য দিয়ে প্রাচীন দক্ষিণ সিল্ক রোডের পুনর্প্রবর্তন ঘটবে; উন্মুক্ত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতার দ্বার।
করোনাকালে চীন দেখিয়েছে ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’, করোনার এই সময়ে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ‘ভালোবাসার নৌকা পাহাড় বাইয়া চলে’ এমন সম্পর্কের বিশ্বাসে আবদ্ধ করেছে। করোনার টিকা পেতে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন কূটনীতিতে যখন জবরদস্ত অবস্থা তখন আবারও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় দেশটি।
উপহার হিসেবে দুই দফায় ১২ লাখ টিকা বাংলাদেশকে দিয়েছে চীন এবং বাণিজ্যিকভাবেও দেশটি বাংলাদেশে ধাপে ধাপে কয়েক কোটি টিকা সরবরাহ করবে এমনটাই আশ্বস্ত করেছে। টিকা সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাথে যৌথ উদ্যোগে চীন টিকা উৎপাদন কার্যক্রম শিগগিরই শুরু করবে বলে এমনটাই আশা করা হচ্ছে। এ নিয়ে দু’দেশের আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে।
ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জানিয়েছেন বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। চীনের এই বন্ধুত্বের কথা মনে রাখবে বাংলাদেশ। অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়টি যদি আবারও বলি, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মধ্য দিয়ে দু‘দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের গতির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই দুই সফরে জ্বালানি, প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে দু’দেশের মধ্যে নানা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। এক পথ এক অঞ্চল কর্মসূচির আলোকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা খাতে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে দেশটি।
পদ্মাসেতু ও কর্ণফুলী নদীতে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সামনে থেকে সহায়তা করছে চীন।
দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে গত বছর বাংলাদেশকে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন। এ নিয়ে মোট ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেল বাংলাদেশ। এর ফলে দেশ দুটির মধ্যে দেশের বাণিজ্যে ঘাটতি কিছুটা কমবে এমন আশা করাই যায়।
গত বছর দুই দেশের কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৪৫তম বার্ষিকীতে বাংলাদেশ-চীন শুভেচ্ছা বিনিময় করে। সেখানে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তিনি আশা করেন, সামনের দিনগুলোতে এই সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্মান, সমতা, দৃঢ় রাজনৈতিক বিশ্বাস ও উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক এমন সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময় উভয় দেশ বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় রচনা করেছে।
দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মানুষের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো জানিয়ে বলেন, ওই সময় থেকে এই দুই প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে জ্ঞান, সংস্কৃতি বিনিময় ও ব্যবসায়ীক লেনদেন ছিল।
১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চীন সফরকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘নতুন চীনকে যেভাবে দেখেছি’ বইতে চীনের জনগণের প্রশংসা করেছেন।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক দিক ছাড়াও কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে চীন সহায়তা করছে এবং আগামী দিনগুলোতে এই সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতি ও অবকাঠামো বিনিয়োগে চীনের অব্যাহত সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করায় চীনের প্রতি ধন্যবাদ জানান।
রোহিঙ্গা নিয়ে কূটনৈতিক জটিলতা এবং চ্যালেঞ্জে পরা বাংলাদেশ তাদের প্রত্যাবাসনেও চীনের সহযোগিতা আশা করে। বাংলাদেশ আশা করে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার এই ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সফলতা আসবে।
বন্ধুকে বিপদে ফেলে চীন নিশ্চয় সেই সহযোগিতার হাত এখানেও প্রসার করবেন। করবেন এ কারণে এটা এখন এ অঞ্চলের নিরাপত্তার হুমকিও তৈরি হচ্ছে।
তবে যাই হোক করোনার এই সময়েও চীনের ‘ভালোবাসার নৌকা পাহাড় বাইয়া চলে’ অন্যদিকে ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’ এ কথাগুলো মাথায় রেখেই বাংলাদেশ-চীন কৌশলগত সম্পর্কে এগিয়ে যাবে এমনটাই আশা করে এদেশের মানুষ।
চীন অনেক বদলে গেছে। সত্তর-আশির দশকের সে চীন এখন আর নেই। আজকের চীন আধুনিক চীন, উন্নত চীন এবং এখানে এখন এক নতুন প্রজন্ম, নতুন নেতৃত্ব। তবে চীনের এত সব পরিবর্তনের মধ্যেও পরিবর্তন ঘটেনি দু’দেশের সম্পর্ক।
যা ঘটবেও না বলে আশা দু’দেশের জনগণের। ‘চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক বন্ধুত্বের, কেবলই বন্ধুত্বের, অন্য কিছু নয়। এসব কথার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন দুই জাতির সাধারণ বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এবং প্রকৃত মৈত্রীর চেতনার মূর্ত প্রকাশ ঘটাবে এমনটাই আশা করে বাংলাদেশ –চীন।
লেখক : মুক্তা মাহমুদ, সাংবাদিক।
ই আই/ মতামত/ ২৫ জুন, ২০২১