বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচন ও সাধারন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে দানিয়েল কোড়াইয়া মাত্র ৯ টি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে সারাদেশে এই কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় ১০৫৬ টি।
এই ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোর শীর্ষ সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে কালব। কালব এর পঞ্চম বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকী সম্প্রতি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুখোমুখী হন ‘ই-বাংলা.প্রেস’র সঙ্গে ।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দুর্নিতি প্রতিরোধ, কৃষক উন্নয়ন ও আগামি দিনের নানাবিধ উন্নয়মূলক পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় তার সাথে । কালব চেয়ারম্যান মি. জোনাস ঢাকীর সেই বিশেষ সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
ই-বাংলা.প্রেস >> বাংলাদেশের সাধারন মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় আন্দোলনের কি ভূমিকা রয়েছে?
জোনাস ঢাকী >> এই দেশে সমবায় আন্দোলনে ২৯ ধরনের সমবায় সমিতি রয়েছে। যেমন- কৃষি ও কৃষক সমবায় সমিতি, শ্রমজীবী সমবায় সমিতি, মৎসজীবী সমবায় সমিতি, তাতী সমবায় সমিতি, ভূমিহীন সমবায় সমিতি ইত্যাদি নানাবিধ সমবায় সমিতি।
এরকম ২৯ টি প্রকারের মধ্যে আমরা ক্রেডিট ইউনিয়ন হলাম ১ টা। এবং কালব হচ্ছে ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোর শীর্ষ সংগঠন। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক আন্দোলনে অবশ্যই এই সমবায় আন্দোলনের পজিটিভ ভূমিকা রয়েছে।
সরকার যদি এই সমিতিগুলোর মাধ্যমে তাঁতীদের ফান্ড সরবরাহ না করতো তবে হয়তোবা আমরা এতোটা সাশ্রয়ী মূল্যে জামদানী শাড়ী পেতামনা, যদি সরকার মৎস সমবায় সমিতির মাধ্যমে টাকা সরবরাহ না করতো তবে সাম্পান দিয়ে মাছ ধরে আমরা এখন দেশের মানুষের যে প্রোটিনের অভাব পূরণ করছি, তা হয়তো পারতামনা। এভাবেই সমবায় আন্দোলন দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিতে অবদান রাখছে।
ই-বাংলা.প্রেস >> দেশের সমবায় আন্দোলনে কালব এর প্রয়োজনীয়তা কি? এর সাথে আপনার সম্পৃক্ততার ইতিহাস কি?
জোনাস ঢাকী >> কালব প্রধানত ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোর অডিট করে থাকে। এছাড়া কালবের প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে, এদেশে যতগুলি ক্রেডিট ইউনিয়ন আছে তার সমন্বয় সাধন করা, দিকনির্দেশনা দেয়া, মনিটরিং করা, আইনী সহায়তা দেয়া, প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা ও সংগঠিত করে তাদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে কাজ করা।
বলে রাখা দরকার ক্রেডিট ইউনিয়নের যাত্রা শুরু ১৯৭৯ সালে ৯ টি সমিতি দিয়ে। এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মি. দানিয়েল কোড়াইয়া। মি. দানিয়েল কোড়াইয়ার শুরু করা সেই ৯ টি ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে সারাদেশে এখন প্রায় ১০৫৬ টি ক্রেডিট ইউনিয়ন তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এবং এযাবৎকাল পর্যন্ত কালব প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার উপরে আমানত সঞ্চয় করেছে। এবং সব ধরনের সমিতি মিলে এই সঞ্চয় প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। এবং এই উদাহরন সারাদেশে ২য় টি নেই। কোন অনুদান ছাড়াই কালব এই আমানত সঞ্চয় করেছে। এই সঞ্চয়ী আমানত থেকে সরকারকে প্রতিবছর আমরা ১৫% আয়কর এবং শতকরা ৩% সিডিএফ কো-অপারেটিভ ডেভলপমেন্ট ফান্ড) প্রদান করি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে এই সিডিএফ এর পরিমাণ ছিলো ১ কোটি টাকার উপরে। তথাপি অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই করোনাকালীন সময়ে আমরা সরকারের কাছে চেয়েও এখন পর্যন্ত কোন প্রণোদনা পাইনি যা আমাদের খুবই প্রয়োজন। আমি ১৯৭৭ সালে আমার প্রাথমিক সমিতি বর্ণালী কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে এই ক্রেডিট ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হই। এবং এই বর্ণালীর ডেলিগেট হিসেবেই আমি কালবের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এবং কালব এর ডেলিগেট হিসেবে আমি এ্যাশোসিয়েশন অব এশিয়ান ক্রেডিট ইউনিয়নের (আকু) ১ম ও ২য় ভাইস চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করি (২০০২-২০০৮)। বলে রাখা ভালো যে আকুর সদস্য দেশ ১৯ টি।
ই-বাংলা.প্রেস >> দেশের বিভিন্ন সমবায় সমিতি সম্পর্কে নানাবিধ বেআইনী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ হরহামেশাই উঠছে। যেমন সদস্যদের টাকার হিসাবে গড়মিল, অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা, প্রতিবাদকারীদের মামলা-হামলা দিয়ে পর্যদুস্ত করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে কালব কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করে বা আদৌ করে কি না ?
জোনাস ঢাকী >> একটা বিষয় জানবেন যে প্রাথমিক সমিতিগুলো স্বায়ত্বশাসিত। প্রত্যেকের প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্বতন্ত্র ও সরকারি আইন দ্বারা পরিচালিত। সেখানে কালবের নাক গলানোর বিশেষ কোন সুযোগ নেই। তবে যদি কোন ক্রেডিট ইউনিয়ন সমিতি কালবের কোন পলিসির ব্যত্যয় করে তবে সেখানে কালব পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
ই-বাংলা.প্রেস >> দেশের সাধারন মানুষকে সমবায় নির্ভর করে তোলাটা কতোটা ইতিবাচক? আগামীতে এর পরিধি বৃদ্ধিতে কালব এর কোন পরিকল্পনা রয়েছে কি ?
জোনাস ঢাকী >> যদি দেশের উন্নতি করতে হয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে কনস্টিটিউশনে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যে অর্থনৈতিকভাবে এটা হলো সেকেন্ড সেক্টর। সেই একইভাবে আমরা মনে করি যদি দেশর প্রগ্রেস হতে হয় তাহলে তা সমবায়ের মাধ্যমেই হতে হবে। ক্যাপিটালিজম দিয়ে সেই কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর পরিধি বৃদ্ধির জন্য আমি ২০০২ সাল থেকে দেশের শিক্ষক সমাজকে নিয়ে প্রত্যেকটি উপজেলায় একটি করে ক্রেডিট ইউনিয়ন তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি, যেন উনারা এই ক্রেডিট ইউনিয়ন বোঝেন এবং এর সম্প্রসারনে তারা যেন আমাদের সাহায্য করেন। সেজন্য প্রাথমিকভাবে তাদেরকে আমরা কিছু ফান্ডিংও করেছি।
এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ২৫২ টি উপজেলায় এটা করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের বোর্ড মিটিংয়ে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি উপজেলায় আমরা এই কার্যক্রম সম্প্রসারন করবো। কোন উপজেলাই আমরা বাদ রাখবোনা। আরো যে বিষয়ে এখন আমরা কাজ করছি তা হলো এগ্রিকালচার কনজিউমার নিয়ে। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন যে, কৃষক যে পণ্যটি উৎপন্ন করবে, কালব তা কিনে নিবে। বিশেষ করে ধান, চাল, শরিষা ইত্যাদি জাতীয় পন্য কালব কৃষকদের কাছ থেকে কিনে মার্কেটে বিক্রি করে যে মুনাফাটা হবে সেখান থেকে কৃষকদের একটা অংশ দেয়া হবে।
এবছর আমরা ট্রায়াল বেসিসে ৩৩০ টন চাল এবং ১০ টন ধান ইতিমধ্যে কিনে নিয়েছি। এখন এগুলো স্টোরে আছে। এগুলো বিক্রি করে আমরা দেখবো কি পরিমান মুনাফা হয় এবং কতোটা আমরা কৃষকদের দিতে পারি। ধরুন কৃষকদের কাছ থেকে আমরা ৭৮ টাকা দরে কিনেছি। আমরা যদি এখন বাজারে তা ৮৫ টাকা দরে বিক্রি করতে পারি তাহলে ঐ কৃষক অন্তত ২ টাকা মুনাফার অংশ পাবে। আর বাকি ৫ টাকা থাকবে কালবের তহবিলে। বিষয়টি সম্পূর্ণই ট্রায়াল বেসিসে করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া কালবকে অর্থনৈতিকভাবে আরেকটু শক্তিশালী করার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই গাজীপুরের কুচিলাবাড়ীতে একটি রিসোর্ট কাম ট্রেনিং সেন্টার তৈরি করেছি। এবং সেটাকে আরো বর্ধিত করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ই-বাংলা.প্রেস >> বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনে সমবায় আন্দোলনের ভূমিকা কতোটা? আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাই?
জোনাস ঢাকী >> দারিদ্র বিমোচন করতে হলে সবার আগে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রয়োজন। এবং আমরা সেই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সঞ্চয়ের মাধ্যমে জনগণকে স্বাবলম্বী করে তুলতে চাই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ঢকা ক্রেডিট কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের বর্তমান মূলধন এখন প্রায় ৮০০ কোটি টাকা এবং তারা তা দিয়ে প্রায় ১ হাজার পরিবারের আবাসন এর ব্যাবস্থা করতে সফল হয়েছে। এবং যদি সম্পূর্ণ স্ট্যটিস্টিকস ধরা হয় সব সমিতি মিলে সারা দেশে হাজার হাজার পোল্ট্রি, ফিশারিজসহ নানাবিধ কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে যা দেশের সার্বিক দারিদ্র বিমোচনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
ই-বাংলা.প্রেস >> দেশের সমবায় সমিতিগুলো ও কালব কি পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত, দুর্নীতি প্রতিরোধে আপনার ভূমিকা ও উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন?
জোনাস ঢাকী >> না, কোন অর্গানাইজেশনই সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া সম্ভব না। কোন কোন ক্রেডিট ইউনিয়নে যে ছোট-খাটো দুর্নীতি হচ্ছে না তা কিস্তু নয়। আমরা এসব ক্ষেত্রে মামলায় যাচ্ছি। আর আমাদের একটা ইন্টারনাল অডিট কমিটি সেল আছে। যারা রেগুলারই এই সমিতিগুলোর ইন্সপেকশনে যায়। অভিযোগ না পেলেও তারা যায়। আমরা এটাকে বলি ইন্টারনাল ইন্সপেকশন। আমাদের পলিসিতেই এটা রয়েছে। সম্ভাব্য দুর্নীতি প্রতিরোধে এই ইন্টারনাল ইন্সপেকশন ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
ই-বাংলা.প্রেস >> বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক দুরাবস্থায় সমবায় সমিতিগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি ও দেশের সাধারন মানুষের সহযোগিতায় কালব কি ধরনের ভূমিকা রেখেছে?
জোনাস ঢাকী >> আপনি খোঁজ নিলে জানবেন যে, এই করোনাকালীন সময়ে আমাদের কালবের অন্তর্ভুক্ত কমপক্ষে দেড়শ সমিতি সরাসরি ত্রাণ সহযোগিতা দিয়েছে। এবং বেশ কিছু সমিতি তাদের সুদও মাফ করে দিয়েছে। এবং ঋনের কিস্তিও স্থগিতও করা হয়েছে। যখন সময় ভালো আসবে তখন ঋনগ্রহীতারা জরিমানা ছাড়া কিস্তি পরিশোধের সুযোগ পাবে।
ই-বাংলা.প্রেস >> আমাদের পাঠক তথা দেশের সাধারন মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আপনার কোন পরামর্শ বা আহ্বান থাকলে বলুন।
জোনাস ঢাকী >> আমি দেশের মানুষের জন্য যেটা বলতে চাই তা হলো, প্রত্যেক মানুষ চাইলে কিছু সঞ্চয় করতে পারে। আমি বহুবার বহস্থানে একথাটি বলেছিও যে যদি আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৭ বা ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ সরাসরি আয় করি। আমরা এই ১০ কোটি মানুষ যদি দিনে ১ টাকা করেও সঞ্চয় করি তাহলে দিনপ্রতি আমাদের সঞ্চয় হবে ১০ কোটি টাকা। এ হিসেবে বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার উপরে সঞ্চয় দাঁড়াবে। এবং এটা যদি করা যায় তাহলে আমাদের সরকার ধীরে ধীরে বৈদেশিক সাহায্যেও নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। তাই আমি দেশবাসীকে বলবো আপনারা সঞ্চয় করুন। নিজে স্বাবলম্বী হোন এবং দেশের অর্থনৈতিক মুক্তিতে অবদান রাখুন।
(সাক্ষাৎকার গ্রহণে : একেএম সীমান্ত)
ই আই/ সাক্ষাৎকার/ ২৭ জুন, ২০২১