দেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে কালোটাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ (প্রায় ৮৯ লাখ) কোটি টাকা। মোটা অঙ্কের এই অর্থ একই সময়ের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বিগত সময়ে (৪৭ বছর) মোট জিডিপি ছিল ২ কোটি ১৪ লাখ ২৪ হাজার ২১৪ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি কালোটাকা হয়েছে আয়কর, মুনাফার ওপর কর এবং মূলধন কর ফাঁকি থেকে। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণামূলক পুস্তক ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।
সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, দেশে বড় অঙ্কের কালোটাকা অর্থনীতিতে যুক্ত করতে আগামী বাজেটেও সাদা করার বিশেষ সুযোগ থাকছে। যা চলতি অর্থবছরেও ছিল। মঙ্গলবার (২৯ জুন) জাতীয় সংসদে পাশের জন্য উপস্থাপন করা হবে অর্থবিল।
সেখানে ঘোষণা থাকতে পারে নির্ধারিত হারে কর ও জরিমানা দিয়ে পুঁজিবাজার, আবাসন ও শিল্প খাতে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে প্রশ্ন করবে না দুর্নীতি দমন কমিশন। এ সুযোগ দেওয়া হলে করোনাকালীন অর্থনীতিতে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আগামী ২৯ জুন অর্থবিল পাশ হওয়ার সময় কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিষয়ে জানা যাবে।
এর আগে প্রস্তাবিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেছিলেন, কালোটাকা সাদা করার পক্ষে ও বিপক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। এজন্য সমীক্ষা করে দেখা হচ্ছে বিষয়টি। এই বিশেষ সুযোগ লাভজনক হলে তা অব্যাহত থাকবে আগামীতেও।
জানতে চাইলে গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত গণমাধ্যমে বলেন, এক টাকাও সাদা করার সুযোগ দেওয়ার দরকার নেই। বরং টাকা পাচারকারী ও কালোটাকার মালিকদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বারাকাত আরও বলেন, সুযোগ না দিয়ে কালোটাকা উদ্ধার করে ঘাটতি বাজেট পূরণ করা সম্ভব। বিশেষ করে ধনীদের সম্পদ কর থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা, বিদেশি নাগরিকদের ওপর কর থেকে ৭ হাজার ৮শ কোটি টাকা, কালোটাকা থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব বছরে। এসব আদায় না হওয়ায় সেটি কালোটাকায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ নামের বইয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর কালোটাকার অঙ্ক বেড়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে- ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ বছরে কালোটাকা হয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা।
শুধু ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে কালোটাকা হয়েছে ১৮ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছরে (১৯৭৩-৭৪) এই অঙ্ক দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ২৫ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা, ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে ২০ হাজার ১শ কোটি টাকা ও ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে কালোটাকা ছিল ১৮ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা।
এছাড়া (১৯৭৭-৮৭)-এই এক দশকে দেশে কালোটাকা হয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। পরবর্তী দশকে (১৯৮৭-৯৭) সেটি বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়ে যায়। এই দশকে সৃষ্টি হয়েছে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। আর ১৯৯৭-২০০৭ পর্যন্ত এই দশকে মোট কালোটাকা ছিল ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
২০০৭-০৮ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত এই দশকে কালোটাকা হয়েছে বিগত একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। এই দশকে দেশে ৪৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩১ কোটি টাকা ছিল কালো। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কালো টাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা।
ওই বইয়ে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কালোটাকা হয়েছে ৮ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৯ দশমিক ৭ শতাংশ আসছে অর্থনীতির বৈধ খাতের অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে। আর বাকি ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ এসেছে ঘুস ও চোরাচালানসহ অন্যান্য খাত থেকে। এসব খাত আইনগতভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কালোটাকা সৃষ্টির উৎস উল্লেখ করে ওই বইয়ে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি হয়েছে আয়কর, মুনাফার ওপর কর এবং মূলধন কর ফাঁকি থেকে। মোট কালোটাকার মধ্যে এসব খাত থেকে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ এসেছে। এরপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকি থেকে কালোটাকা হয়েছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।
সরকারি ও বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ঘুস থেকে কালোটাকা হয়েছে ১২ শতাংশ। এভাবে চোরাচালান থেকে আসছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি থেকে আসছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অন্যান্য অবৈধ খাত থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আমদানি শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে এসেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কালোটাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করা বিশেষ একটি সুযোগ দেওয়া হয়। এর আওতায় গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে।
অপ্রদর্শিত আয় রিটার্ন প্রদর্শনের আওতায় ৯ হাজার ৬২৩ করদাতা এ সুযোগ নিয়েছে। একই সময়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা আয়কর পরিশোধ করেছেন।
এক বছরে লগইনসহ নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে ব্যক্তিশ্রেণির ৩১১ জন করদাতা এ সুযোগ নিয়েছেন। ফলে করোনাকালীন দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিপ্রবাহ এবং পুঁজিবাজারে অর্থপ্রবাহ বেড়েছে। এতে শক্তিশালী হয়েছে পুঁজিবাজার। সূত্র : যুগান্তর অনলাইন।
ইই/ অর্থনীতি/ ২৯ জুন, ২০২১