‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের সংকেত

বিশেষ প্রতিবেদক :

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হয়তো ইতিমধ্যে সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়া অতিক্রম করেছে। কিন্তু ভারতের প্রথম শনাক্ত করোনাভাইরাসের নতুন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশসহ এশিয়া এবং বিশ্বের বহু দেশকে বিপদের দিকে ফেলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক ড. ট্রেড্রস আধানম গেব্রেইয়েসুস শনিবার (২ জুলাই) এক বিবৃতিতে বলেন, কমপক্ষে ৯৮টি দেশে ভারতে প্রথম শনাক্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। ড. গেব্রেইয়েসুস আরও বলেন, এই ভ্যারিয়েন্টটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটির কাঠামোগত এবং চারিত্রিক রূপান্তর ঘটে চলেছে। তিনি বলেন, নতুন এই ভাইরাস এতটাই দ্রুত গতিতে বিস্তার করছে তাতে যেসব দেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রম ভালো হয়েছে সেখানেও ছড়াচেছ।

ব্রিটেনে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে তার প্রধান কারণ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কিন্তু অক্সফোর্ডে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক জেমস নেইস্মিথকে উদ্ধৃত করে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে, পুরো ইউরোপ জুড়ে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়বে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় ডেকে আনছে

 

উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিণতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এই বিজ্ঞানী। “উন্নয়নশীল বিশ্বে এত কম মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছে যে তাদের সামনে চরম বিপদ অপেক্ষা করছে। ডেল্টা যখন ব্যাপকভাবে ছড়াতে শুরু করবে, দ্রুত ঐসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপর্যয় তৈরি হবে, যদি না দ্রুত টিকা কর্মসূচির প্রসার করতে না পারে। গেব্রেইয়েসুস আরও বলেছেন, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে, অক্সিজেনের অভাব দেখা দেবে এবং ডাক্তার নার্সরা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকহারে টিকা কর্মসূচি অব্যাহত থাকলেও ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও উদ্বেগেউৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। তবে বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলোকে, বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম তালিকায়।

কঠোর বিধি-নিষেধ ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন। ছবি সংগৃহীত।

বর্তমান সময় ভারতের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে দেখা গেলেও প্রথম শনাক্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেকগুলো দেশে বিপজ্জনক মাত্রায় নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ এবং মৃত্যু। আর এই প্রবণতা এমন সময় হাজির হয়েছে যখন এই সব অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই টিকা কর্মসূচির পরিস্থিতি নাজুক।

চলতি বছরের গত মে মাসেই নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় নতুন করে সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় নেপালে। মে মাস থেকে নেপালে দ্রুতহারে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে যে কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ চরমে পৌঁছেছে।

জুন মাসে আফগানিস্তানে সংক্রমণের সংখ্যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি হয়ে পড়ে। আফগান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়াজিদ মজরুহ বলেন, সারা দেশে যত সংক্রমণ হচ্ছে তার ৬০ শতাংশই হচ্ছে রাজধানী কাবুলে। তিনি বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এই অবস্থা।

সংক্রমণ সামাল দিতে দেশজুড়ে কঠোর লক-ডাউন চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং মঙ্গোলিয়াতে সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপক হারে বাড়ছে। তাই এসব দেশগুলোতে দ্রুত ব্যাপক টিকা কর্মসূচিসহ প্রয়োজনী ও যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আরও চরম বিপদে পড়তে হতে পারে।

যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ত্রিমুখী ও দীর্ঘ সীমান্ত সেই বাংলাদেশে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে নতুন করে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে শুরু করে। সরকারি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে (৭ জুন) পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় যতজন কভিড-১৯ পজিটিভি শনাক্ত রোগী পাওয়া গেছে, তাদের ৬৮ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ছিল। সংক্রমণ সামাল দিতে এখন দেশজুড়ে কঠোর লক-ডাউন চলছে।

এশিয় অনেক দেশের আগেই টিকা কর্মসূচি শুরু করলেও, খুবই মন্থর গতিতে চলছে এ কর্মসূচি। ভ্যাকসিনের অভাবে এপ্রিল থেকে টিকা দেওয়া স্থগিত করে দিতে হয়। ভারত থেকে পাওয়া এবং কেনা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৬ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসলেও হঠাৎ করে ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। দেশে এতে টিকা প্রয়োগে চরম সংকটে পরে। কঠোর বিধিনিষেধ ভঙ্গকারিদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের আইনী ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন।

চীনের কাছ থেকে অনুদান হিসাবে পাওয়া কিছু ভ্যাকসিন দিয়ে (২২ জুন) থেকে স্বল্প মাত্রায় ফের টিকা প্রয়োগ শুরু করা হয়। অবশ্য সরকার বলছে, দেশে সিনোফার্ম, মডার্না এবং ফাইজারের ৫৭ লাখ ডোজ টিকা এসেছে যা দিয়ে দ্রুত নতুন করে পুরোমাত্রায় টিকা দেওয়া শুরু হবে। তবে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, জুনের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশেরও কম মানুষের দুই ডোজ টিকা হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া : সংক্রমণ বাড়ায় ইন্দোনেশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে (২০ জুলাই) পর্যন্ত কঠোর লক-ডাউন জারী করা হয়েছে। সেদেশটির সরকার জানিয়েছে, ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই ইন্তোনেশিয়তে এই পরিস্থিতি।

দেশটির স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে গত তিন সপ্তাহে যতজন কোভিড পজিটিভ রোগী সনাক্ত হয়েছে তাদের ৬০ শতাংশই সংক্রমিত হয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে।রেডক্রস বলছে হাসপাতালের বেড এবং অক্সিজেনের অভাব যেভাবে প্রকট হচ্ছে তাতে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া।

ইন্দোনেশিয়াযর পাঁচ শতাংশ জনগণকেও এখনো পুরোপুরি ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে বলছেন, দিনে ১০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার টার্গেট নিয়েছে তার সরকার।

থাইল্যান্ড : থাই সরকার বলছে, সম্প্রতি যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। থাইল্যান্ডে রাজধানী ব্যাংকক ছাড়াও পর্যটন নগরী ফুকেতের মত কিছু দ্বীপেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। থাইল্যান্ডে এ পর্যন্ত মাত্র চার শতাংশ মানুষের টিকা দেওয়া গেছে।

চীন থেকে পাওয়া সিনোফার্ম টিকার বদৌলতে মঙ্গোলিয়া টিকা কর্মসূচিতে অসামান্য সাফল্যে ৫০ শতাংশ মানুষ সেদেশে টিকা নিয়ে ফেলেছে।

চীন থেকে পাওয়া সিনোফার্ম টিকার বদৌলতে মঙ্গোলিয়া টিকা কর্মসূচিতে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে। এ পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ার ৫০ শতাংশ মানুষ টিকা পগ্রহণ করতে পেরেছে।

তারপরেও সম্প্রতি থাইল্যান্ডে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।এত করে মঙ্গেলিয়ায় সম্প্রতি যেভাবে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বাড়ছে তাতে জনসংখ্যার শতকরা হারে এশিয়ায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশটিতে।

আর এ কারণে, করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে চীনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তবে মঙ্গোলিয়ার একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন চীনা ভ্যাকসিন নয়, বরঞ্চ জুনে লক-ডাউন তুলে নেওয়ার পরইে এই সংক্রমণ বেড়েছে।

ইন্দোনেশিয়াতেও ৮৫ শতাংশ ভ্যাকসিনই চীনের তৈরি। সেখানে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া বেশ কজন স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যুর পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

শুধু দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই নয়, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ এখন ইউরোপ ছাড়িয়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রামক রোগ বিষয়ক ইন্সটিটিউটের প্রধান এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপদেষ্টা ড. অ্যান্টনি ফাউচি শনিবার (২ জুলাই) মার্কিন এক টিভি সাক্ষাতকারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সেখানে তিনি বলেন, সারা দেশে না হলেও যে সব অঙ্গরাজ্য টিকা কর্মসূচিতে পিছিয়ে আছে সেসব অঞ্চলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে আমেরিকার ভরসা এটাই যে জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ ইতিমধ্যেই অন্তত এক ডোজ টিকা গ্রহণ করতে পেরেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) ছাড়াও বিশ্বের অনেক শীর্ষ বিজ্ঞানীরা সাবধান করে বলেছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এতটাই সংক্রামক যে, এ থেকে বাঁচার আপাতত একটাই রাস্তা, দ্রুত ভ্যাকসিনের প্রসার।

(ডব্লিওএইচও)’র প্রধান ড গেব্রেইয়েসুস বলেন, জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিটি দেশের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ লোককে টিকা দিতে হবে। “এটাই এই প্যানডেমিক সামলানোর সবচেয়ে কার্যকরী রাস্তা। আর এই রাস্তা দিয়ে হাটতে না পারলে বিশ্বজুড়ে এর চরম মূল্য দিতে হবে।

ই-বাংলা/ করোনাভা/ ৫ জুলাই, ২০২১

Contact Us