চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোটের সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়েন আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. শাহ নেওয়াজ রুমেল। নৌকা নিয়ে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৬৭ ভোট। ইউপির ৯টি কেন্দ্র মিলিয়ে তিনি এই ভোট পান। এতে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
এটি বাংলাদেশে নৌকা প্রতীক নিয়ে সর্বনিম্ন ভোট পাওয়ার নতুন রেকর্ড। এমনকি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী নাজের হোসাইন থেকেও কম ভোট পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী। হাত পাখা প্রতীক নিয়ে নাজের হোসাইন পেয়েছেন ৭১ ভোট। তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ মনোনয়ন বাণিজ্যেই নৌকার ভরাডুবি।
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বড় ধরনের হারের পেছনে প্রধান কারণ হলো জনপ্রিয় ও যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় বিভেদও পরাজয়ের একটা কারণ। তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই নৌকার পরাজয় হয়েছে, স্থানীয়ভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের নৌকা দেওয়ার সুপারিশ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে সবচেয়ে কম যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন, তৃণমূল নেতাদের সুপারিশেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা, মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রভাবশালী এমপিদের এলাকায় নৌকার প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছেন। ভগ্নিপতিকেও জেতাতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রভাবশালী মন্ত্রীরা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ মুহূর্তে নৌকাবিরোধী ভোটকে ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের। অধিকাংশ জায়গায় দলের বিদ্রোহীরাই বিজয়ী হচ্ছেন। প্রার্থী বাছাইয়ে গলদ কোথায় তা খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ফরিদপুরকে আওয়ামী লীগের উর্বর ভূমি বলা হয়। সেই ফরিদপুরে সদ্য অনুষ্ঠিত ভোট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভোটারদের মধ্যে নৌকাবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে জেলার ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন উপজেলায় নৌকার ভরাডুবির রেশ কাটতে না কাটতেই চতুর্থ ধাপেও ফের এই ভরাডুবি ঘটেছে বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলায়।
এ এলাকাটি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আবদুর রহমানের এলাকা। তিনি এই আসনের সাবেক এমপি। বর্তমান এমপি মনজুর হোসেন। এ দুই উপজেলায় ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টিতে নৌকার পরাজয় হয়েছে। পরাজয়ের পেছনে মনোনয়ন বাণিজ্যকেই দুষছেন তৃণমূল নেতারা।
এ প্রসঙ্গে চতুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘নৌকার পরাজয়ের মূল কারণ হচ্ছে ওপরের নেতারা। তাদের মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীরা মনোনয়ন পাননি। স্বজনপ্রীতি ও বাণিজ্যের কারণে যাদের স্বাধীনতার প্রতীক নৌকা তুলে দেওয়া হয়েছে তারা হেরে গেছেন। বলা যায় নৌকা হারেনি, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে পরাজয় হয়েছে।’
চতুর্থ ধাপে নৌকার পরাজয় প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেকেই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। মনোনয়ন একজনকে দিতে হয়। মনোনয়ন না পেলেই তাদের চরিত্র পাল্টিয়ে ফেলেন। দলের পক্ষে যে ভূমিকা রাখা দরকার তারা তা করেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তির জ্ঞাতিগোষ্ঠী, আঞ্চলিকতা নানা কিছু নির্ভর করে। সে কারণে ফলাফল বিপর্র্যয়। আমরা বিব্রত।’ নিজ নির্বাচনী এলাকায় (বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা) নৌকার পরাজয়ের কারণ প্রসঙ্গে ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালের শেষ দিক থেকে মূলত এই এলাকা সাংগঠনিক রাজনীতিশূন্য। এখানে কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড হয় না। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এমপি কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। সে কারণে আওয়ামী লীগের উর্বর ঘাঁটিতে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে।’
চতুর্থ ধাপের ইউপি ভোটে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার চার ইউনিয়নে একমাত্র নারী প্রার্থী ছিলেন হাসিনা বেগম। নৌকা নিয়ে তিনি খাতামধুপুর ইউনিয়নে পেয়েছেন মাত্র ৯৩ ভোট। এমন শোচনীয় পরাজয়ের পর তিনি অসহযোগিতার অভিযোগ করেন দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, চতুর্থ ধাপের ওই ইউপি নির্বাচনে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ের মধ্যে একমাত্র নারী প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পাই। সেখানে আমার বিজয়ও নিশ্চিত ছিল। কিন্তু আমার পরাজয় ঘটানো হয়েছে। দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পরও সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমল হোসেন সরকারের ভাই মাসুদ রানা বাবু পাইলট।
এ বিষয়ে খাতামধুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমল হোসেন সরকার বলেন, যিনি প্রার্থী হয়েছেন তিনিই বলতে পারবেন তার শোচনীয় পরাজয়ের কারণ। তাকে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তৃণমূলের সেখানে কোনো মতামত ছিল না। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে একমাত্র মাসুদ রানা বাবু পাইলটকে প্রার্থিতা প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল।’ এ প্রসঙ্গে সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোখছেদুল মোমিন বলেন, ভুল মনোনয়নে নৌকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এ জন্য অনেকেই দায়ী। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ এত উন্নয়ন করার পরও শতকের নিচে নৌকার ভোট চরম লজ্জার।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার কালাই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজহার আলী ভোট পেয়েছেন মাত্র ১১২টি। ৯টি কেন্দ্রে তিনি এই পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। এই ইউনিয়নে বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী অটোরিকশা প্রতীক নিয়ে জুবায়দুর রহমান সবুজ ৪ হাজার ৪৭৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা ও তিনটি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। ১৩টির মধ্যে মাত্র ৩টি ইউনিয়নে নৌকা সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। আর বিএনপি সমর্থন করা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৭টি ইউনিয়নে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ২টিতে এবং অপর একটিতে জামায়াতের প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
নেত্রকোনার হাওর উপজেলা খালিয়াজুরীতে চারটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুটিতে বিদ্রোহী এবং একটিতে বিএনপি ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। একটিতে মাত্র নৌকার বিজয় হয়েছে। এখানে যোগ্য লোকেরা মনোনয়ন পাননি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এ উপজেলায় বাড়ি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের। তার ভগ্নিপতি নাজিম উদ্দিন কৃষ্ণপুর ইউনিয়নে নৌকা নিয়ে পরাজিত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি স্বাগত সরকার শুভ বলেন, ‘যোগ্য প্রার্থী নির্ধারণ করা হয়নি। অযোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে এমপির পছন্দের ব্যক্তিদের নৌকা দেওয়া হয়েছে। সে কারণে তৃণমূল ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। যোগ্য ব্যক্তিরা বাণিজ্যের কারণেই বঞ্চিত হয়েছেন।’
সিলেটে গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন মাত্র ৭টিতে। আর বাকি ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে স্বতন্ত্রের ব্যানারে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৪টিতে, বিএনপি ৩টিতে ও জামায়াত ৪টিতে বিজয়ী হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির একজন ও এক প্রবাসী স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। দুই ইউনিয়নে জামানতও হারিয়েছেন নৌকার প্রার্থী। প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত, তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থী পরিবর্তন, বিদ্রোহীদের দাপট ও অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং-দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। ঝিনাইদহে ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টিতে হেরেছে আওয়ামী লীগ। এখানে বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ৭টিতে বিদ্রোহী ও ৬টিতে নৌকার প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া দুটিতে বিএনপিপন্থি প্রার্থী বেসরকারিভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনগরের টেংরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন মাত্র ২৬৪ ভোট। একই উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের আরেক প্রার্থী পেয়েছেন ৯১৮ ভোট।
ফলাফল বিবরণী থেকে জানা যায়, টেংরা ইউপির ৯টি কেন্দ্র মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ মাহমুদ উদ্দীন ২৬৪ ভোট পেয়েছেন। নিজের ভোট কেন্দ্র ছাড়া কোনো কেন্দ্রেই তিন অঙ্কের ভোট পাননি। ৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮টিতেই তিনি ৩০-এর নিচে ভোট পেয়েছেন।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৯টি ইউপির মাত্র দুটিতে নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। বাকি ৭টিতে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দাপটের সঙ্গে জয়ী হয়েছেন। ৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয়ের জন্য দলীয় প্রার্থী বাছাইকে দায়ী করেছেন তৃণমূলের আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা।
তারা বলেছেন, প্রার্থী বাছাইয়ে ত্যাগী ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, ক্লিন ইমেজ- এসব দেখা হয়নি। নির্বাচনে পরাজিত নৌকার প্রার্থীরা শুরু থেকেই নির্বাচনী মাঠ জমাতে পারেননি। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকার ফলে ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিয়ে শুরু থেকেই নেতা-কর্মীরা কয়েক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। এর প্রভাব ভোটে ফুটে উঠছে বলে ধারণা দলীয় লোকজনের।
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ৭টিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা হেরেছেন। ওই সাতটি ইউপির চারটিতে স্বতন্ত্র ও দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। মনোনয়ন বাণিজ্য ও সঠিক প্রার্থী বাছাই না করার কারণে আওয়ামী লীগের এমন ভরাডুবি হয়েছে বলে দাবি করছেন স্থানীয় নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, এলাকায় জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আবেদন করে অনেকেই দলের মনোনয়ন পাননি।
তাদের আবেদন বিবেচনা না করে মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা নেই এমন ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ফলে ভোটাররা ওই প্রার্থীদের ভোট দেননি। জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগটি সঠিক নয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমিটির সমন্বয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড যোগ্য প্রার্থীদেরই দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। তবে নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের বিষয়ে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ও পারিপার্শ্বিকতা অনেক কিছুই কাজ করে।
ইবাংলা /টিআর /২৮ ডিসেম্বর