ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনা উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়ে উঠেছে ইউরোপের জন্য। ইউরোপের দেশগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘরে জ্বালানি চাহিদা পূরণের সবচেয়ে বড় উৎস রাশিয়ার গ্যাস। নতুন করে যুদ্ধের মেঘ জমতে শুরু করায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এখন হন্যে হয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহের বিকল্প খুঁজছে বলে জানানো হয়েছে সিএনএন- এর এক প্রতিবেদনে।
শীতকালে সবচেয়ে ঠাণ্ডার সময়টার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ। এ মুহূর্তে বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজে পাওয়া একটি কঠিন কাজ। এ কারণেই পুরো মহাদেশের জন্য জ্বালানির উৎস নিয়ে এমন উদ্বেগ।জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ারর্সের পূর্ব ইউরোপ বিশেষজ্ঞ ইয়ানিস ক্লুগে সিএনএনকে বলেন, “বাস্তবিক অর্থেই এর কোনো দ্রুত কিংবা সহজ বিকল্প নেই।”
হোয়াইট হাউজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, এ সপ্তাহে তারা বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেছেন, যাতে জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানো হয়। তারা প্রাকৃতিক সম্পদের বিকল্প উৎসও চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন, যা ইউরোপে পাঠানো সম্ভব।রাশিয়ার গ্যাস ইউক্রেইনের ওপর দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে। রাশিয়া ওই পাইপলাইন বন্ধের মত পদক্ষেপ নিলে তা জ্বালানির বাজারে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
নতুন পাইপলাইন কিংবা তরলীকৃত গ্যাস আমদানির জন্য স্থাপনা নির্মাণে কয়েক বছর সময় লাগবে। আর বিকল্প উৎস থেকে যদি বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আনতে হয়, সেটা কাতারের মতো বড় গ্যাস রপ্তানিকারকদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব না।মহামারীর এই সময়ে বৈশ্বিক পরিবহন নেটওয়ার্ক ও বিশ্ব বাজার যখন এক ধরনের স্থবিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় কাতারেরও খুব বেশি কিছু করার সুযোগ সম্ভবত নেই।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মজুদ সংকট। ইউরোপ এখনই জ্বালানির টানাপড়েনের মধ্যে আছে। গ্যাসের দাম যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। যদি আবহাওয়া আরও খারাপ হয়, ঠাণ্ডা আরও বাড়ে, সেক্ষেত্রে কষ্টে থাকা গ্রাহক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরও বেশি জ্বালানি জোগাতে সরকারগুলোকে জ্বালানি রেশনিংয়ের পথেও যেতে হবে পারে।
সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নিকোস টসাফস বলেন, সরবরাহে বিঘ্ন হলে একটি দেশ বিপাকে পড়ে, তবে পুরো ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু রাশিয়ার গ্যাস যদি ইউরোপ না পায়, সেটা হবে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
“ইউক্রেইনের ভেতর দিয়ে বন্ধ-চালু-বন্ধ-চালু ব্যবস্থায় গ্যাস এলে তাও ইউরোপকে বেকায়দায় ফেলবে, তবে তখনও হয়ত কাজ চালানো যাবে। কিন্তু রাশিয়া থেকে জ্বালানি রপ্তানি পুরো বন্ধ হয়ে গেলে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। ওই পরিমাণ ঘাটতি পূরণ ইউরোপের জন্য অসম্ভব।”
পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের বরাতে সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২০ সালেও রাশিয়া এককভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩৮ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের যোগান দিয়েছে, যার পরিমাণ ১৫ হাজার ৩০০ কোটি ঘন মিটার।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। বিশেষ করে তারা কয়লা ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর পর এই নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। ইতালি ও অস্ট্রিয়াও রাশিয়ার গ্যাসের ওপর টিকে আছে যা মূলত ইউক্রেইনের ভেতর দিয়ে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়।
ডাচ ব্যাংক আইএনজির ম্যাক্রো রিসার্চ বিভাগের বৈশ্বিক প্রধান কারসটেন ব্রজেস্কি বলেন, “এটা হচ্ছে সেরকম একটা মুহূর্ত যখন ‘হায় আমার খোদা’ বলে বসে পড়ার মত অবস্থা হয়, এ অঞ্চলটি এখন হঠাৎ উপলব্ধি করতে পারছে যে তারা রাশিয়ার গ্যাসের ওপর কতটা নির্ভরশীল।”
প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ করা যায়। কিন্তু ইউরোপের মজুদ এখন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে গেছে, কারণ গত বছর থেকে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি কমিয়েছে।ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির প্রধান ফেইথ বিরোল এ মাসের শুরুর দিকে বলেছিলেন, বাজারমূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকার পরেও রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রম ২০২১ সালের শেষ তিন মাসে ইউরোপে রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমিয়েছে।
হোয়াইট হাউজের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা হুঁশিয়ার করেছেন, মস্কো তার জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে সেজন্য চড়া মাশুল গুণতে হবে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় বাজেটের অর্ধেকের যোগান আসে তেল ও গ্যাস রপ্তানির আয় থেকে।ইউক্রেইনে যুদ্ধ বাঁধলে তাতে যদি গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি হয়, তা সামাল দিতে বিকল্প প্রস্তুতিও চলছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতে একটি বিকল্প হতে পারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির সরবরাহ বাড়ানো, যা পাইপলাইনের বদলে সমুদ্রগামী ট্যাংকারের মাধ্যমে সরবরাহ করা সম্ভব।কিছু সরবরাহ এরইমধ্যে ইউরোপে পাঠানো হয়েছে, বিশেষ করে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পর। ইনডিপেনডেন্ট কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের এলএনজি বাজার বিশ্লেষক অ্যালেক্স ফ্রলি বলেন, জানুয়ারিতে ইউরোপে রেকর্ড পরিমাণ এলএনজি রপ্তানি করা হচ্ছে।
কিন্তু আরও অনেক বেশি সরবরাহ দরকার, যদি রাশিয়া থেকে সরবরাহ থমকে যায়। সেটার ব্যবস্থা করা কঠিন, যেহেতু বাজারে এখন চাহিদা অনেক বেশি।ফ্রলি বলেন, “বৈশ্বিক এলএনজি উৎপাদন এরইমধ্যে বলা যায় সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। তাছাড়া বাণিজ্যিক পথগুলো বদলানোর চেষ্টা হলে জাহাজ চলাচলে একটি জটিলতা সৃষ্টি হবে।”
ডিসেম্বরে বিশ্বের শীর্ষ এলএনজি রপ্তানিকারকের স্থান দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা হয়ত উৎপাদন কিছুটা বাড়াতে পারে। কাতার, যারা ইউরোপের পাঁচ গুণ এলএনজি এশিয়ায় রপ্তানি করে, তারাও উৎপাদন বাড়াতে পারে। কিন্তু তা দিয়েও পুরো ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সিএসআইএসের টসাফস বলছেন, ইউরোপে এলএনজি পাঠিয়ে রাশিয়ার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ধাক্কা যদি সামলানো সম্ভবও হয়, সেই এলএনজি ইউরোপের দেশগুলোতে সরবরাহ করার মত জটিল অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
ফলে রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে ওই ঘাটতি মেটানোর তাৎক্ষণিক কোনো বিকল্প এ মুহূর্তে ইউরোপে নেই। কারণ রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহ ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের কর্মকর্তা ক্লুগ বলেন, “এই শীতে, রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া আমাদের আসলেই কোনো বিকল্প নেই।”
ইবাংলা / নাঈম/ ২৮ জানুয়ারি, ২০২২