‘মা আমি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হয়েছি। নিশ্চয় তুমি এর মধ্যে জেনে গেছ। জানি, তোমাদের কাছে এত বড় গৌরবের খবর এখন ভালো নাও লাগতে পারে। তবে দল আমাকে মূল্যায়ন করেছে। মা এবার আমি তোমাদের অনুরোধ করব-তোমরা আর সময় নষ্ট করো না। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জাতীয়তাবাদী শক্তির পতাকাতলে চলে আসো।’ কথাগুলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের।
তিনি তার মাকে রোববার (১৭ এপ্রিল) রাতে মোবাইল ফোনে এমন অনুরোধ জানান। সোমবার (১৮ এপ্রিল) তিনি বলেন সংগঠন নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা, প্রস্তুতির কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই অনেকটা আবেগঘন কণ্ঠে এমন কথা বলেন। এরপর তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি আওয়ামী লীগ পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও আমার একই আহ্বান থাকবে। আসুন, দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকুন, দেশ গঠনে কাজ করুন।’
প্রসঙ্গত, শ্রাবণের বাবা যশোরের কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম। এছাড়া তিনি কেশবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তার বড় ভাই মোস্তাফিজুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদে অনেকদিন দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। আরেক ভাই মুজাহিদুল ইসলাম উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক। ছোট ভাই আজাহারুল ইসলাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক। এককথায়-শ্রাবণের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত।
রোববার (১৭ এপ্রিল) বিকালে কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি এবং সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫ সদস্যের আংশিক কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা করে বিএনপি। শ্রাবণ বিদায়ি কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি, জুয়েল ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক।
সোমবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ বিভিন্ন প্রশ্নে খোলামেলা কথা বলেন। আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য হয়ে কীভাবে ছাত্রদলের রাজনীতিতে এভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু কারণে কলেজ জীবনে ছাত্রদলের রাজনীতি আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
অন্যান্য সংগঠনের চেয়ে তাদের মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী, স্মার্ট ও রুচিশীল নেতাকর্মীর সংখ্যা বেশি ছিল। এরপর মনের অজান্তে আমি ছাত্রদলকে বুকের মধ্যে লালন করতে থাকি। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সক্রিয়ভাবে ছাত্রদলের রাজনীতি শুরু করি।’
এ কারণে গত ১০ বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আছেন জানিয়ে ছাত্রদলের সভাপতি আরও বলেন, ‘আমার পরিবার ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে আমার আদর্শিক দূরত্ব থাকবে। আমার পরিবার হয়তো মনে করেছে-ভিন্ন রাজনীতির কারণে আমার সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখলে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু এটা শুধু আমার পরিবার নয়, পুরো দেশেরই একই চিত্র।’
শ্রাবণ মনে করেন, ‘এখন ভিন্নমতের রাজনীতির কারণে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত দেশকে বিভক্ত করা হয়েছে। ঘরে ঘরে কোন্দল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার পরিবার যেহেতু আওয়ামী লীগ করে, তাই তাদের চরিত্রও আওয়ামী লীগের বাইরে যাবে না। সুতরাং তারা আমাকে অস্বীকার করবে-এটাই স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, ‘মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পারি না। তবে আদর্শিক কারণে আমি গর্বিত। সংগঠনের স্বার্থে আমাকে আমার পরিবার বিসর্জন দিতে হয়েছে। কিন্তু আশার কথা, দল আমার সে আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করেছে। এই দৃষ্টান্ত অন্যদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে।’
এই মুহূর্তে মূল চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘তাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগামী তিন মাসের মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা, ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড, থানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি করে সংগঠনের সবাইকে একটা সাংগঠনিক পরিচয় দেওয়া।’
ছাত্রদলের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কী-এমন প্রশ্নের জবাবে সভাপতি শ্রাবণ বলেন, ‘ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্ররাজনীতিকে গতিশীল করা এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা। এজন্য শুধু ছাত্রদল নয়, সব রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে চাই।’
সভাপতি নিয়ে সাধারণ সম্পাদক জুয়েলও গর্বিত : ছাত্রদলের সভাপতি আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য বিষয়টি কীভাবে দেখছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, ‘দেখুন, জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো। আমাদের এটি একটি আদর্শিক চিন্তার বিষয়। তার (বর্তমান সভাপতি) পূর্বসূরিরা আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী হিসাবে তার মধ্যে এই বিশাল চিন্তার বিকাশ ঘটেছে। এতে দেশ ও দেশের মানুষ বেশি উপকৃত হবে।
তিনি দেশের একজন নাগরিক হিসাবে গণমানুষের ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে শুধু বুকের মধ্যে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধারণ করেননি, নিজের যোগ্যতা, মেধা ও আত্মত্যাগ দিয়ে আজ এই অর্জন করেছেন। আমি মনে করি, তার মতো এভাবে দেশের সব ছাত্রসমাজকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পতাকাতলে দলে দলে সমবেত হওয়া উচিত।’
সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘সভাপতি শ্রাবণ ছাত্রদলের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাকে নির্বাচিত করে প্রিয় সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান একটি মাইলফলক উন্মোচন করলেন যে, এখানে এসে শুধু পরিবারকেন্দ্রিক কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটে না। ছাত্রদলের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয় তাদেরকেই, যারা সামগ্রিকভাবে দেশের চিন্তা ধারণ করেন।’আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তা আদায় করে নেওয়া হবে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্রদল সব সময়ই সরব থাকে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এখন ছাত্রদলই সবচেয়ে আবেদনময়ী সংগঠন। সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য ইতোমধ্যে আমরা তৃণমূলেও সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করেছি। ওয়ার্ড থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত পুনর্গঠিত করেছি। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি নিচ্ছি, যাতে প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি হয়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রশিক্ষিত কর্মীই রাজনৈতিক দলের প্রাণ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলছি, যাতে তারা অধিকার সচেতন থাকে।
সাইফ মাহমুদ জুয়েল আরও বলেন, ‘আমাদের বিগত কমিটির পাইওনিয়ার কর্মসূচি ছিল থানা, উপজেলা, পৌরসভা এবং কলেজ কমিটিগুলো গঠন। কেননা সারা দেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ কমিটি গঠনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিগুলোর কাজও অগ্রসরমান আছে। আমরা দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করছি-এখানে মেধাবী, নিবেদিতপ্রাণ এবং রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদেরকেই মূল্যায়ন করা হবে। এখানে ব্যক্তিপছন্দ কিংবা অংশবিশেষের পছন্দের কোনো প্রতিফলন ঘটবে না।’
সংগঠনের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যারা জাতীয়তাবাদী আদর্শে রাজনীতি করি তথা ছাত্রদল করি, নিঃসন্দেহে তারা সময়ের সাহসী সন্তান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন তা চলমান রয়েছে। আগামী দিনে সেই আন্দোলনে নিঃসন্দেহে যত বিভীষিকাময় ও ভয়ংকর পরিস্থিতিই আসুক, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেছে, তারা সেই পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে। তাই সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি তাদেরকে বলতে চাই, ‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই-নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
ইবাংলা/ এসআর / ১৯ এপ্রিল,২০২২