ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন বালিয়ারপুর মহাসড়কে ডাকাতি প্রস্তুতিকালীন সময়ে দুর্ধর্ষ আন্তজেলা ডাকাতচক্র ‘ঠান্ডা-শামীম বাহিনী’র সর্দারসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
র্যাব জানায়, ঠাণ্ডা-শামীম বাহিনীর মূলহোতা শামীম ওরফে সব্দুল এবং তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড আনিসুর ওরফে ঠান্ডা। তাদের নাম অনুসারে বাহিনীর নাম রাখা হয় ঠান্ডা-শামীম বাহিনী। ঠান্ডা-শামীম বাহিনীর সদস্যরা অন্ধকার রাস্তায় ওৎ পেতে থাকত।
গ্রেফতারকৃতরা হলো মো. শামিম ওরফে সব্দুল (৩০) এবং সহযোগী মো. আনিসুর রহমান ওরফে ঠান্ডা (৪৫), মো. সালাউদ্দিন (২৩), মো. ইখতিয়ার উদ্দিন (৩১), মো. সাইফুল ইসলাম (৩৫), মো. জাহাঙ্গীর সরকার (৪০), মো. সজিব ইসলাম (২৫), মো. জীবন সরকার (৩৪), শ্রী স্বপন চন্দ্র রায়, মো. মিনহাজুর ইসলাম (২০) ও শ্রী মাধব চন্দ্র সরকার (২৬)।
এসময় তাদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল ১টি, পাইপগান ১টি, ওয়ান শুটারগান ২টি, গুলি ৬ রাউন্ড, ম্যাগাজিন ১টি, শাবল ১টি, রশি ৩টি, লোহার রড ১টি, চাপাতি ১টি, রামদা ২টি, চাইনিজ কুড়াল ১টি, করাত ১টি, হাউজ কাটার ১টি, ছুরি ২টি, টর্চ লাইট ২টি, ব্যাগ ১১টি, হ্যাকসো ব্লেড ২টি, পা ১টি, লেজার লাইট ২টি, প্লাস ২টি, দেশি কুড়াল ১টি ও হাতুড়ি ১টি জব্দ করা হয়।
শুক্রবার (৩ জুন) দিবাগত রাত ১টার দিকে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।
র্যাব আরও জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহ ডাকাতি, সড়ক ডাকাতি, গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাত্রীবাহী বাস, গরুবাহী ট্রাক, মালবাহী ট্রাক ও বিভিন্ন মালামালের গুদামে ডাকাতি করে আসছে চক্রটি। ডাকাতি করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিত নির্ধারিত স্থানের নিকটবর্তী স্টেশনে ডাকাত দলের সদস্য টার্গেট বাস,ট্রাক, মাইক্রোবাস সম্পর্কে সংকেত দিত।
এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধির উপর নজরদারি করে মূল ডাকাত দলের নিকট তথ্য সরবরাহ করত। অনুকূল সংকেত পাওয়া মাত্রই ডাকাত দলের মধ্যে গাছ কাটার দায়িত্ব প্রাপ্ত সদস্যরা দ্রুত গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে দিত। অন্যদিকে ডাকাত দলের অপর সদস্যরা বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাসের চালক ও যাত্রীদের অস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে পালিয়ে যেত।
যেখানে গাছ কাটার সুযোগ থাকেনা সেখানে তারা চালকের চোখে আলো ফেলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ডাকাতি করত। এসব ডাকাতির ঘটনায় শামীম এবং আনিসুর) ঠান্ডা একাধিকবার আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছে। জেলহাজতে থাকার সময় তাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন অপরাধীদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে।
পরবর্তীতে জামিনে বের হয়ে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে বর্ণিত ডাকাত বাহিনী গড়ে তোলে। তাদের বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৫ জন। এছাড়াও, তারা যে এলাকায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করে উক্ত এলাকার স্থানীয় অপরাধী ডাকাত/মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও পরিবহন শ্রমিক/গোডাউনের কর্মচারী/নৈশ প্রহরীদের সাথে যোগসাজশ করে ডাকাতির মূল পরিকল্পনা করে থাকে। ডাকাতিই হচ্ছে তাদের মূল পেশা।
শনিবার (৪ জুন) দুপুর ১২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার সালাউদ্দিন ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরবর্তীতে সার্বিক বিচার বিবেচনা করে আনিসুর ওরফে ঠান্ডা, শামীম এবং সালাউদ্দিন একত্রে বসে ডাকাতির মূল পরিকল্পনা করে।
কোনো জায়গায় কখন কিভাবে ডাকাতি করা হবে, ডাকাতির তথ্য সংগ্রহের জন্য কাকে নিয়োগ করতে হবে, কিভাবে ডাকাতি সম্পন্ন করা হবে, ডাকাতিকৃত মালামাল কোথায় কখন কিভাবে পরিবহন, সংরক্ষণ ও কার নিকট বিক্রি করে অর্থ আদায় করা হবে ইত্যাদি পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাতির জন্য নির্ধারিত স্থানে সালাউদ্দিন পূর্বেই গোপনে অবস্থান করে তথ্য সংগ্রহ করত। ডাকাতি শেষে নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার বিষয়ে ঠান্ডা শামীমকে পরিকল্পনা প্রদান করত এবং ঠান্ডা-শামীমের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত।
তিনি বলেন, গ্রেফতার ইখতিয়ার উদ্দিন এই বাহিনীর অন্যতম সদস্য। সে পেশায় ড্রাইভার। বিভিন্ন সময় ডাকাতির ধরণ অনুযায়ী মিনি ট্রাক, মাইক্রোবাসসহ চাহিদা অনুযায়ী যানবাহন সরবরাহ করে নিজে চালকের ভূমিকা পালন করত। ডাকাতির পূর্বে ঘটনাস্থল রেকি, ডাকাতির সময় ও ডাকাতি শেষে ঘটনাস্থল হতে পলায়ন এবং ডাকাতির মালামাল পরিবহনের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
গ্রেফতার সাইফুল পেশায় রাজমিস্ত্রি। ডাকাতি করার সময় সে তালা ভাঙ্গা, দেওয়াল ভাঙ্গা, গাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করাসহ ডাকাতির মালামাল বিক্রির দায়িত্ব পালন করে থাকে।
গ্রেফতার মিনহাজুল এবং মাধব চন্দ্র ‘ঠান্ডা-শামীম বাহিনী’র তথ্যদাতার কাজ করে থাকে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করে স্থানীয় অপরাধীদের সাথে ঠান্ডা-শামীম বাহিনীর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। ডাকাতি পূর্ব রেকি এবং ডাকাতির সময় স্থানীয় অপরাধীদের সাথে অবস্থান করে ডাকাতিতে অংশ নেয়। মহাসড়কে ডাকাতির সময় তারা গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কাজ করে থাকে।
গ্রেফতার জাহাঙ্গীর পেশায় ইট ভাটার শ্রমিক, সজীব ও জীবন পেশায় গার্মেন্টস শ্রমিক, স্বপন চন্দ্র পরিবহন শ্রমিক। তারা এসব পেশার আড়ালে ডাকাত দলের সাথে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। ডাকাতি শেষে তারা আবার নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেফতার আনিসুর ওরফে ঠান্ডা ২০০৪ সাল থেকে ডাকাতি করে আসছে। ২০১৬ সালে শামীম এর সাথে তার পরিচয়ের সূত্রে তারা একসাথে বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করতে থাকে। এছাড়াও, ঠাণ্ডা-শামীম বাহিনী তাদের ডাকাতির ধরন এবং চাহিদা অনুযায়ী ভাড়ায় লোকবল সংগ্রহ করে থাকে।
এই বাহিনী ইতোমধ্যে গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, টাঙ্গাইল এলাকায় বহু ডাকাতি করেছে বলে জানা যায়। তারা বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খল বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে। ডাকাতি হতে প্রাপ্ত মালামালের অর্ধেক আনিসুর ওরফে ঠান্ডা এবং শামীম ভাগ করে নিত। বাকি অর্ধেক মালামাল অন্যদের কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া হত।
ডাকাতি হতে প্রাপ্ত সম্পদ ভোগ বিলাস ও মামলার খরচ মেটাতে ব্যয় করত বলে জানা যায়। আসামিরা সাম্প্রতিক সময়ে বগুড়ার শেরপুর এলাকার মহাসড়কে ডাকাতির কথা স্বীকার করে। এছাড়াও, তারা সাভারের হেমায়েতপুরে ১টি ব্যাটারির কারখানায় ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই তারা গ্রেফতার হয়।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার ঠাণ্ডা-শামীম বাহিনী’র মূলহোতা শামীমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৭টি ডাকাতি মামলা ও আনিসুর ওরফে ঠান্ডা’র বিরুদ্ধে ডাকাতি, মাদক ও বিভিন্ন অপরাধের ৫টি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
ইবাংলা/টিএইচকে/৪ জুন,২০২২