জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হয়েছে ছয় মাস। এরই মধ্যে শুক্রবার (১ জুলাই) সেই কমিটি স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তবে, স্থগিতের কোন কারণ উল্লেখ না করলেও টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রলীগ নেত্রীকে কু-প্রস্তাব, কমিটির পদধারী নেতাকর্মীদের কোনঠাঁসা করে রাখাসহ অনেক ঘটনা সামনে এসেছে।
জবি সূত্রে জানায় যায়, শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের দ্বিতীয় তলার টিনসেড বিল্ডিং, ডরমেটরি ভবন মেরামত, মনোবিজ্ঞান ভবনের ছাদ মেরামতসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের সংস্কার, ইলেকট্রনিক্স পণ্য ক্রয়, ল্যাবরেটরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা, ক্যালেন্ডার ডায়েরি তৈরির প্রায় দেড় কোটি টাকার টেন্ডার হয়।
সব কয়টি টেন্ডার জবি ছাত্রলীগ সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ও এস এম আকতার হোসেনের নির্দেশিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এসব টেন্ডারের বাজেট থেকে ১৫ শতাংশ এ দুই ছাত্র নেতার পকেটে ঢুকতো বলে একাধি সূত্রের অভিযোগ।
তবে শীর্ষ এ দুই নেতার পুরনো ঢাকার ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজি ছাপিয়ে আলোচনায় কেরাণীগঞ্জের নতুন ক্যাম্পাসের টেন্ডার। নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণে সীমানা প্রাচীরের ৩৩ কোটি ও মাস্টারপ্লানের ৫ কোটি টাকার টেন্ডার পান স্থানীয় এক প্রতিমন্ত্রী, আর উপজেলা চেয়ারম্যানের পছন্দের প্রতিষ্ঠান কিংডম বিল্ডার্স আর আরবানা লিমিটেড।
এদিকে নতুন ক্যাম্পাসের ২৭ কোটি টাকায় লেক নির্মাণ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লানিং দপ্তরের ৬২ কোটি টাকার টেন্ডারে বাগড়া দেয়ার অভিযোগ রয়েছে নতুন কমিটির দুই শীর্ষ নেতা। এ ঘটনায় স্থানীয় ওই প্রতিমন্ত্রী জবি ছাত্রলীগের প্রতি মনক্ষুণ্ন হন। আর লেক নির্মাণের টেন্ডার পায় মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মীর কাশেম আলীর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া ভবন নির্মাণে বিএনপির এক নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও ইজিপিতে টেন্ডার জমা দেয়। জানা যায়, ভবন নির্মাণে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানই টেন্ডারে অংশ নেয়।
জবি ছাত্রলীগ নেত্রীকে কুপ্রস্তাব: এদিকে কমিটি স্থগিতের পর পরই জবি ছাত্রলীগের নারী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফৌজিয়া আক্তার প্রিয়ন্তি সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে নানান সময়ে কুপ্রস্তাব ও আবদার মেটাতে চাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর থেকে সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতারের রাজনীতি করি। কিন্তু তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর চরিত্র বদলে যায়। বিভিন্ন সময়ে তিনি আমাকে কুপ্রস্তাব দেন। এ কারণেই আমি রাজনীতির মাঠ থেকে সরে আসতে বাধ্য হই। আকতার বিভিন্ন সময় বলতেন ‘তার কথা না শুনলে, ছাত্রী হলের কমিটিতেও কেউ পদ পাবে না!’
এ নেত্রী জানান, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রীদেরকেও বলে দিয়েছেন আমাকে কেউ সালাম দিলেও পদ পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হলে ৩০০ এর বেশি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উঠলেও আমাকে উঠতে দেননি আকতার।
একদিন ছোট বোনদের দেখতে গেলে আকতার হলের প্রভোস্টকে ফোন দিয়ে আমাকে হল থেকে বের হতে বাধ্য করেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করায় আকতার আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দিচ্ছেন।
জবি ছাত্রলীগের একাধিক পদধারী নেতা জানান, বর্তমান কমিটির সভাপতি ইব্রাহীম ফিরাজী ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন কমিটি হওয়ার পরই ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজীসহ আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করেন।
এছাড়াও বর্তমান কমিটির পদধারী নেতাদেরকে কোনঠাসা করে রাখতে জুনিয়রদের সামনে অপমান অপদস্ত করতে থাকেন। সভাপতি সম্পাদক ক্যাম্পাসে আসলে ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তর আর প্রশাসনিক দপ্তরে যাওয়া আসা ছাড়া আর কোন কার্যক্রম চোখে পড়ে না।
এদিকে গত ২৬ জুন ওয়ারীতে জবির শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম হলের কাছে সংগীত বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী রাষ্ট্রপতির ছেলের গাড়িচালককে মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরদিন সন্ধ্যায় ওয়ারী থানায় কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন ভুক্তভোগী চালক নজরুল ইসলাম।
এছাড়া জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে কয়েকটি গুরুতর অভিযোগে কমিটি স্থগিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।
তারা বলেন, ‘ইব্রাহীম ও আকতারকে সভাপতি-সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণার পর থেকেই পুরান ঢাকায় লুকিয়ে তারা বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেন। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিসিটিভির ফুটেজ তো সবার কাছেই আছে।
অপরদিকে গত ১১ মার্চ নবীন শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ দলে ভেড়ানোকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় জবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মালিটোলা পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও টিএসসি এলাকার এ ঘটনায় প্রায় ১০ জন আহত হন।
আর আড়াই লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় গত ৬ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এফ আর হিমাচল পরিবহনের একটি বাস পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকা থেকে এনে জবির ফটকের সামনে আটকে রাখে আকতার হোসাইনের অনুসারী ও দর্শন বিভাগের ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান। জানা যায়, ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা থেকে চলা বাস থেকে মাসিক কয়েক লাখ টাকা মাশোয়ারা দিতে হয় জবি ছাত্রলীগকে।
২০১৪ সালের হল আন্দোলনের সময় সমবায় ব্যাংকের মালিকানা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের জমিটি দখল করে শিক্ষার্থীরা জায়গাটিকে ‘টিএসসি’ হিসেবে দাবি করে আসছে। ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক জায়গাটি কয়েকবার বেদখল হলেও সর্বশেষ ২০১৭ সালের শুরুতে আবারেও দখলমুক্ত করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এরপর স্বাভাবিকভাবে চললেও বর্তমানে স্থগিত হওয়া ছাত্রলীগ কমিটি এটি সংস্কার করে নতুন করে চালু করে। মাসে দুই লাখ চাঁদা তোলার অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া গত জুনে ইসলামপুরে এক বিচারে জবি ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সিদ্ধান্ত না মানায় এক ব্যবসায়ীকে তুলে আনারও অভিযোগ আছে। ৫০ লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় সদরঘাটের গ্রেটওয়ালের এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে তুলে আনার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এক নেতার ছেলেকে বাড়িতে গিয়ে মারধরের অভিযোগ রয়েছে ফরাজি আর আকতারের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা বলেন, জবি শাখা ছাত্রলীগের প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কিছু নির্দেশনা ছিল। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও তারা তা পালন করেনি। এছাড়াও তাদের নামে একাধিক অভিযোগ আসে কেন্দ্রে। এর প্রেক্ষিতে জবি ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ও সাধারণ সম্পাদক এস এস আকতারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা কল রিসিভ করেননি। আর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের পাওয়া যায়নি। সূত্র : banglanews24.com
ইবাংলা/টিএইচকে/৩জুলাই,২০২২