সংগীতের সাথে বাঙালি দিয়ে সম্পর্ক যেন অতপ্রত। আর এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বহুকাল থেকে। বাংলা তথা উপমহাদেশ তাইতো সঙ্গীতের বিশ্ব ইতিহাসের পরিবেশনায় উজ্জ্বল নক্ষত্রে হয়ে আছেন।
তাইতো সংগীত সংশ্লিষ্টদের ঐক্যবদ্ধ করে দেশীয় সংস্কৃতিকে আরও বিকশিত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শেষ হলো সংগীতের প্রথম জাতীয় উৎসব ও সম্মেলন।
উৎসবটি আয়োজন করেছে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মূল মঞ্চে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এই উৎসব।
সংগীত উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি।
বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ-এর মহাসচিব শহীদ মাহমুদ জঙ্গী।
সন্ধ্যার পরপরই জাতীয় সংগীত বাজানোর মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। এরপর সংগীত পরিবারে প্রয়াতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সংগীতের জাতীয় উৎসব অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংগীত ঐক্যের দুই মহাসচিব কুমার বিশ্বজিৎ ও নকীব খান। এরপর বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কে এম খালিদ এমপি এবং প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি।
বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলি লাকী। উৎসব সভাপতি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর বক্তব্য দিয়ে শেষ হয় আয়োজনের প্রথম পর্ব।
সম্মানিত প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেন, ‘আমাকে যখন বলা হলো এই আয়োজনের কথা, তখন আমার কাছে মনে হলো এটা বিরল সুযোগ। এটা হাতছাড়া করতে চাইনি। কারণ সংগীতের তিনটি সংগঠন মিলে যে আয়োজন বা ঐক্য করেছে সারা দেশের শিল্পীদের নিয়ে, এটা প্রশংসনীয়।’
তিনি বলেন, ‘শিল্পীরা আমৃত্যু গেয়েই গেছেন, কী পেলেন সেই হিসাব মেলাননি। এবার ভাবার সময় এসেছে শিল্পীদের যোগ্য সম্মান ও সম্মানী ফিরিয়ে দেওয়ার। সকল জটিলতা সমাধানের এখনই সময়। সংগীত ঐক্য প্রণীত ১৮ দফা প্রস্তাবনা আমি দেখেছি। এতে একটি লক্ষ্য রয়েছে। সেটার মধ্য দিয়েই কার্যকর ফল আসতে পারে। এটাই ঐক্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
বাংলার মাঝি থেকে কৃষক, মা থেকে শিক্ষক- সবাই গান ভালোবাসেন। এখন ভিডিও দেখি সিনেমার মতো লাগে। সময়ের সঙ্গে এগুলোকে আমরা আলিঙ্গন করছি। তাই এই সুযোগগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে। ঐক্যের দাবিগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক।
যার অনেকখানি পূরণ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিশেষ করে কপিরাইট আইন সংশোধন, রয়্যালটির ন্যায্যতা ও সম্মানী বৃদ্ধি হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এগুলোর উদ্যোগ নিলে আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য শতভাগ আন্তরিক থাকবো।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দারুণ এক সুখবর দেন শিল্পীদের।
তিনি জানান, খুবই অল্প সময়ের মধ্যে চালু হচ্ছে শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট। যেটি সূচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শিল্পীরা হৃদয়ের তাগিদে গান করেন। আমরা তাদের কিচ্ছু দিতে পারিনি। অথচ এই সংগীত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। যুদ্ধে কী পরিমাণ প্রেরণা যুগিয়েছে গান, ভাবা যায় না।
কাজেই সংগীতের যে দাবিগুলো উত্থাপিত হয়েছে এই ঐক্যের মাধ্যমে, সেগুলো সব যৌক্তিক। এগুলো বাস্তবায়নের পথে আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।’
উৎসব সভাপতি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বলেন, ‘১৯১৫ সালে গ্রামোফোন থেকে প্রথম রয়্যালটি নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর আমরা এই ২০২২ সালে এসেও সেই রয়্যালটি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নিয়ে কথা বলছি। ধরে নিলাম এই আলাপের মধ্য দিয়ে আমরা আইন পাবো, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করবে কে? সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে সমানভাবে।
দেশে খেলার মাঠ নেই, সংস্কৃতির চর্চা ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসবের দিকেও আমাদের সবার নজর দিতে হবে। তবেই আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটবে সমানতালে।
আমরা চাই না, আমাদের নতুন প্রজন্ম গান-বাজনা থেকে সরে যাক, শিল্পীদের সন্তানরা বিদেশে পাড়ি জমাক।’
এর আগেই বক্তব্য রাখেন সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের দুই মহাসচিব কুমার বিশ্বজিৎ ও নকীব খান।
কুমার বিশ্বজিৎ বেশ মজা করেই বলেন, ‘এখানে আসার পর মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আমাকে বললেন, কিভাবে একই রকম নিজেকে ধরে রাখলেন? আমি তখন বললাম, আমাদের যে অবস্থা- একবেলা খাই তো আরেক বেলা উপোষ থাকি। এভাবেই অভাব-অনটনে নিজেকে একই রকম রাখছি! কথাটা যদিও মজা করে বলা, তবে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের মানুষগুলোর বাস্তব চিত্র কিন্তু এমনই।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই প্রথম এভাবে আমরা এক হতে পেরেছি। এটা বড় প্রাপ্তি। সংগীতের তিন অংশীজন এবারই প্রথম এক হয়েছি- এটাও একটা বড় ঘটনা। এক ছিলাম না বলেই সবাই আমাদের ব্যবহার করেছেন, শেষে সাহায্য দিয়েও নিউজ কাভারেজ নিয়েছে! এই হলো আমাদের অবস্থা। এটা আর চাই না। আমরা পাওনাগুলো বুঝে পেতে চাই এবার। ১৮টি প্রস্তাব দিয়েছি। সেটির দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। এটা হিমালয় না হয়ে যেন দ্রুতলয় হয়, সেটাই প্রত্যাশা।’
আরেক মহাসচিব নকীব খান বলেন, ‘একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা হয় তিনটা বিষয় দিয়ে। মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। তার মানে একটি রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সংগীতটাও জড়িত। ফলে গানটাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। আমরা এফএম রেডিও শুনি, সেখানে সারাদিন গান বাজে। রয়্যালটি দূরের কথা, কে গাইলো কে বানালো সেটাও তারা বলে না।
ফলে আমাদের জোরালোভাবে এগোতে হবে এবং সেটা এভাবেই একসঙ্গে। এটার আর বিকল্প নেই।’
বিকালে ছিল মতবিনিময় সভা। এতে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শতাধিক শিল্পী-সংগঠক।
এ সময় সংগীত ঐক্যের অর্থ ও দফতর সচিব আসিফ ইকবাল বলেন, ‘সংগীত আসলে মিলিত কর্মকাণ্ড। অথচ আমরা ছিলাম খাপছাড়া। মাঝে অন্যরা অনেক কিছু নিয়ে গেছেন। আর আমরা হয়েছি দুস্থ-অবহেলিত। তবে এই ঐক্যের মাধ্যমে সংগীতের সেই অশুভ দিনগুলো মুছে যাবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।’
মতবিনিময়ে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের সভাপতি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বিদেশ থেকে ভিডিও বার্তায় নিজের বক্তব্য জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা এতকাল এক ছিলাম না। এবার সেটা হলো। এটাকে ধরে রাখতে হবে। এটাই আমাদের শক্তি।’
আয়োজন সঞ্চালনা করেন সংগীতশিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল।রাত ৮টা থেকে শুরু হয় জমকালো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। শুরুটা হয় শিশুদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা দিয়ে।
এরপর উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, লোকগান, চলচ্চিত্রের গান, অডিও অ্যালবামের গান এবং ব্যান্ড সংগীতের পরিবেশনা ছিল একে একে। বিভিন্ন পর্বে গান পরিবেশন করেন শওকত আলী ইমন, মেহরীন, দিনাত জাহান মুন্নী, জয় শাহরিয়ার, কিশোর, কোনাল, জয়িতা, রন্টি, সন্ধি, সভ্যতা, শাওন গানওয়ালা, হৈমন্তী, অবন্তী, এ আই রাজু, ইউসুফ, আকাশ মাহমুদ, রাজু আহমেদ, অপু আমান প্রমুখ। ব্যান্ডের মধ্যে গান পরিবেশন করে সোলস ও ফিডব্যাক। শেষে একটি বিশেষ পরিবেশনায় অংশ নেন মানাম আহমেদ, নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ ও বাপ্পা মজুমদার।
গত ১৭ জুন চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল সংগীতের প্রথম জাতীয় উৎসব ও সম্মেলনের সূচনা পর্ব। পরে সিলেট ও বরিশালেও একই সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। পুরো উৎসব ও সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে সংগীতের তিন সংগঠন গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশ, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি বাংলাদেশ ও সিংগার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সম্মিলিত মঞ্চ ‘সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ’।
সংগীতের সব পক্ষের মাঝে যোগসূত্র তৈরি ও যৌথভাবে প্রণীত উন্নয়ন প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও কপিরাইট দফতরের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছে এই সংগঠন।
সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ মনে করে, ৫০ বছর ধরে গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীরা নানা অনিয়ম, অবহেলা আর প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
এ পরিস্থিতি উত্তরণের লক্ষ্যে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গীতিকবি, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীরা এক ছাতার নিচে আসেন। গঠিত হয় ‘সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ’।
সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ-এর প্রথম ও বর্তমান কমিটিতে রয়েছেন, সভাপতি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মহাসচিব (৩ জন) শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, নকীব খান ও কুমার বিশ্বজিৎ, অর্থ ও দফতর সচিব আসিফ ইকবাল, তথ্যপ্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সচিব হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, সাংস্কৃতিক সচিব বাপ্পা মজুমদার, প্রচার ও প্রকাশনা সচিব জুলফিকার রাসেল এবং নির্বাহী সদস্য মানাম আহমেদ, কবির বকুল, শওকত আলী ইমন ও জয় শাহরিয়ার।
বাঙালির এই মানসপটে সংগীতের বিচরণ আরো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হবে সংগীতে বাংলা হয়ে উঠবে বিশ্ব নেতৃত্ব। এটাই আজ আমাদের প্রত্যয়।
ইবাংলা /মশিউর /১৭ই জুলাই, ২০২২