দেশি-বিদেশি হাজারো ষড়যন্ত্র, কারিগরি জটিলতা ও প্রাকৃতিক শত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ও খরস্রোতা নদীতে দোতলা পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান।
২৫শে জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভোধনের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন, আবেগ-অনুভূতি, ভালোবাসা, গর্ব – অহংকার, আত্ন-মর্যাদা, সক্ষমতা ও হার-না-মানার প্রতীক । তবে এটি শুধু বিশ্বব্যাংকের সাথে চ্যালেঞ্জ নয়, কারিগরি দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে অনন্য সেতু।
পদ্মা সেতু শুধু নদীর দুই পাড়কেই যুক্ত করেনি, বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে অনেক দেশের সঙ্গে। সেতুতে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা – কর্মচারীর মেধার সমন্বয়, বিদেশি উপকরণ ও দেশীয় যন্ত্রপাতির মেলবন্ধনে নির্মিত হয়েছে গর্বের পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতুর বিশদ নকশা প্রনয়ণে নেতৃত্ব দেন লম্বা নকশা প্রনয়ণে বিশেষজ্ঞ ও ব্রিটেনের রানির কমান্ডার অব দ্য অর্ডারে ভূষিত ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। নকশা প্রণয়নে ব্যবস্থাপক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কেন হুইটলার। তাছাড়া নদীশাসনের নকশা করেন কানাডার ব্রুস ওয়ালেস এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের তদারকির নেতৃত্ব দেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট জন এভস।
যে তিনটি বিশ্ব রেকর্ডের জন্য পদ্মা সেতু অদ্বিতীয়
প্রথমটি – পাইলিং
খরস্রোতার দিক থেকে অ্যামাজনের পর প্রমত্তা পদ্মা নদীই বিশ্বে বৃহত্তম। প্রমত্তা পদ্মায় সেতু তৈরিতে পিলারের (খুঁটি) সংখ্যা ৪২ আর স্পান ৪১। দুটি পিলার নদীর দুই তীরে। প্রতিটি পিলার নির্মাণে ৯৮ থেকে ১২২ মিটার গভীর পাইলিং করা হয়েছে, যা বিশ্বরেকর্ড।
আরও পড়ুন…ভোজ্যতেলের দাম কমলো লিটারে ১৪ টাকা
পৃথিবীর কোনো সেতু নির্মাণে এত গভীর পাইলিং করতে হয়নি। পদ্মা সেতুর পাইলগুলো তিন মিটার ব্যাসার্ধের যা বিশ্বে বিরল । পদ্মা সেতুর প্রতিটি পাইল ৫০ মিলিমিটার পুরু স্টিলের পাইপে মোড়া। হাইড্রোলিক হ্যামারের মাধ্যমে পিটিয়ে পাইল পাইপগুলো নদীতে পোঁতা হয়েছে। বিশ্বে কোনো সেতু নির্মাণে এত গভীরে স্টিল পাইপ পুঁতা নজিরবিহীন ঘটনা।
দ্বিতীয়টি – ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং
ভূমিকম্পের আঘাতকে অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভাষায় হরাইজন্টাল লোড সামলানোর জন্য পিলারে পৃথিবীর বৃহত্তম ৯৬ সেট ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং বসানো হয়েছে যাদের প্রত্যেক সেটের সক্ষমতা ১০ হাজার টন।
বুয়েটের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল, যিনি আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো থেকে পদ্মা সেতুর আন্তর্জাতিক এক্সপার্ট প্যানেলে যুক্ত থেকেছেন,তিনিও বলেছেন পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত পৃথিবীর বৃহত্তম ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং এর মত এত বড় বিয়ারিং এর আগে অন্য কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এই বিয়ারিং এর জন্য রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারবে পদ্মা সেতু।
ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল আরও বলেছেন, পদ্মা সেতুতে দুই পিলারের মাঝখানের লোড বা ওজন ধারণ করার জন্য ট্রাস ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে । ট্রাস প্রযুক্তি কতগুলো ত্রিভুজের সমাবেশ ঘটানো হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই পদ্মা সেতুর লোড বা ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
শুধু তাই না – পদ্মা সেতুর পিলারগুলোর নিচে অনেক গভীর পাইলিং করা হয়েছে। তা করতে গিয়েও নতুন নতুন সমস্যা ইঞ্জিনিয়ারদের মোকাবিলা করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন…ইবির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের নতুন ডিনের দায়িত্ব গ্রহণ
আপনারা শুনলে বিস্মিত হবেন, সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী রেলগাড়ি বা যানবাহনের ওজন, সেসবের গতির প্রতিক্রিয়া কিংবা সেতুর নিজের ওজনই শুধু হিসাব কষতে হয়নি,পানির লোড, বাতাসের ধাক্কা, ভূমিকম্পের কথা, দুর্ঘটনাবশত কোনো জাহাজের পিলারে ধাক্কার ক্ষতিও হিসাবে রাখতে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারদের।
তৃতীয়টি – নদীশাসন
পদ্মা সেতুর কাজে আরেকটি উল্লেখযোগ্য রেকর্ড নদী শাসন। নদীশাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এর আগে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র বিশ্বে আর হয়নি। পলিমাটির দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের নদীর পাড় দ্রুত ভাঙার সাথে সাথে এর গতিও বদলে যায়।
এই জন্য নদীর ট্রেইনিং বা নদীশাসন অঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রমত্তা পদ্মার নদী ভাঙন রোধ এবং নদীর গতি প্রবাহ ঠিক রাখা, সেতুর নিচ দিয়ে নদীকে বইতে বাধ্য করা ছিলো অন্যতম চ্যালেঞ্জ । এই চ্যালেঞ্জ জয় করা না হলে দেখা যাবে, সেতু সেতুর জায়গায় থাকলেও নদীর গতিপথ চলে গেছে অন্য জায়গায়।
পদ্মা সেতুর প্রকৌশলগত জটিলতা নিরসনে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। আমৃত্যু সেই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্যমতে — পানি প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজানের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা ও গতি পরিবর্তনশীল নদী পদ্মা।
আরও পড়ুন…বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন শুরু
সেকেন্ডে ১৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয় এই নদীতে। সেতুর নকশা প্রণয়ণের সময় এই বিষয়টিকে মাথায় রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ।
তিনি বলেছিলেন, একশ বছরে পদ্মায় কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতে পারে, সেই হিসাবটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, মাত্র ২০ সেকেন্ড যে পরিমাণ পানি পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা দিয়ে পুরো ঢাকা শহরের সব মানুষের একদিনের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এই রকম ইঞ্জিনিয়ারিং দিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু একদম আলাদা।
ড.জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ দলের প্রধানের দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়া। তিনি সেতু নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ভূত কারিগরি সমস্যা, এর সমাধান, সেতুর কাজের মানসহ বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ের মূল দায়িত্বে ছিলেন। পদ্মা সেতুর পাইলিং ও পিলারের নকশার জটিলতা সম্পর্কে তিনি বলেন –
পদ্মা সেতুর জন্য প্রতিটি পিলারে ৬টি করে বসানো খুঁটির প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিশালী হ্যামার দিয়েও ১২০ মিটার / ৪২০ ফুট অর্থাৎ ৪২ তলার মত গভীরে যখন শক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন বেশ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।
তখন পিলারের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে সর্বোচ্চ ১২৪ মিটার পর্যন্ত পাইলিংয়ের চুক্তি ছিল সেতু কর্তৃপক্ষের।
এ ক্ষেত্রে নতুন করে চুক্তির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ অবস্থায় বিকল্প একটি উপায় খুঁজে বের করে পদ্মা সেতুর পরামর্শকরা। সেই জন্যই পাইলের দৈর্ঘ্য ঠিক রেখে প্রতিটি পিলারে ৬টির পরিবর্তে ৭টি করে খুঁটি বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। তবে, এখানে বাড়তি যোগ করা হয় গ্রাউটিং প্রযুক্তি।
এর আগে দেশের কোথাও গ্রাউটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় নি। এভাবে সমাধান করা হয় পদ্মা সেতুর পাইলিং ও পিলারের নকশা জটিলতার। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রকৌশলীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম । তিনি বলেন –
* প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিলো পদ্মার তলদেশে নরম মাটি ও সেতুর দানবাকৃতির পাইল। এটার ব্যাস কিন্তু বিশাল, দশ ফুট অর্থাৎ একটা ঘরের সমান। এক একটা পিয়ার বা খুটিতে ৬-৭ টা বড় বড় পাইল দিতে হয়েছে।
আরও পড়ুন…মর্টার শেল বহনকারি কার্গো বিমান বাংলাদেশে আসার পথে গ্রিসে বিধ্বস্ত
* এই নদীতে ৬২ মিটার স্কাওয়ার, মানে ৬২ মিটার পাইল কোন লোড নিবে না, যখন পাইলিং ড্রাইভ করা হয় তখন স্কাওয়ার নেই, স্কাওয়ার যেকোনো সময় হতে পারে। স্কাওয়ার হতে পারে ধরে নিয়ে ইঞ্জিনিয়াররা সেতুর কাজ করেছেন।
* সবচেয়ে গভীর পাইল গেছে সেটা প্রায় ৪২০ ফুট নিচে। ফলে এক একটা পাইল যে পরিমান নিচে গিয়েছে, বলা যায় ৪০ তলার সমান গভীর থেকে উঠে এসেছে।
* নির্মাণ সাইটে বন্যার কারণে ডেক ভেঙে গিয়ে তৈরি হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। ১৩৫ টির মত ব্রডওয়ে ডেক ও রেলের স্টিলের বিম প্রবল বন্যায় ভেসে যায়।
* আমাদের পদ্মা সেতুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য দেখতে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন এস ( S) অক্ষরের মত হলেও ইঞ্জিনিয়াদের জন্য তা ছিলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এস ( S ) এর মত হওয়ায় ৪১ টি স্প্যান ৪১ রকমের। ফলে যেটার যেখানে বসার কথা সেখানেই লাগাতে হয়েছেন।
সোজা হলে যেকোনটা যেকোন জায়গায় সহজেই লাগানো যেতো। ফলে যেগুলো ভেঙে গেছে যেগুলো অন্য জায়গা থেকে এনে লাগানোর কোন উপায় ছিলো না বরং নতুন করেই তৈরি করতে হয়েছে।
* নির্মাণ সামগ্রিক বেশিরভাগ বিদেশ থেকে তৈরি করে নিয়ে আসতে হয়েছে । এখানেও অনেক জটিলতা ছিলো। বাংলাদেশে বানানোর মত অবকাঠামো না থাকায় চীন থেকে তৈরি করে নিয়ে আসতে হয়েছে স্প্যান। চীনে ১৫০ মিটার স্প্যান বানিয়ে ও তার উপর ডেক দিলে ক্রেন উঠাতে পারে না।
পরে স্প্যানের ছোট -ছোট অংশ তৈরি করে বাংলাদেশে এনে ৩২০০ টনের ১৫০ মিটারের স্প্যান তৈরি করা হয়েছে। এই জন্য পদ্মা সেতুতে ৯২,২৮৬ টন স্টিল ও ২,৮২,০০০ টি স্টিল প্লেট ব্যবহৃত হয়েছে যা সংগ্রহ করাও ছিলো অত্যন্ত জটিল। বালি, পাথর, রড, সিমেন্ট বাংলাদেশের নিজস্ব হলেও বাকি সব কিছু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে।
* এত বড় সেতু তৈরির কাঁচামালের জটিল সংগ্রহ প্রক্রিয়া, আর্থিক ও কারিগরি হিসাব – নিকাশ পদ্মা ব্রীজের মত এত বড় প্রজেক্ট পূর্বে না করায় বেশ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে কারিগরি ও প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ বিষয়ে আরো কথা বলেন বুয়েটের অধ্যাপক বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ ড.আইনুন নিশাত। তিনি বলেন- পদ্মা সেতু প্রকৌশল জগতে প্রায় অসম্ভব একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এ সেতুর নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে পাইলিং, নদী শাসন প্রত্যেকটা জায়গায় প্রকৌশলীদের যথেষ্ট কারিগরি ও প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন – পদ্মা নদীতে পাথর না থাকায় সেতুর পুরো ভার মাটির মধ্যেই রাখতে হয়েছে। এই জন্য একমাত্র পদ্মা সেতুর জন্য জার্মানি থেকে বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানানো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার দিয়ে ১০ ফুট ডায়ামিটারের স্টিলের পাইল পিটিয়ে মাটির নিচে ঢোকানোর পরও শেষ পর্যন্ত কাজ না হওয়ায় ইঞ্জিনিয়ারদের নকশা পরিবর্তন করে যথেষ্ট জটিলতার মধ্য দিয়ে সে কাজ করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন…সর্বোচ্চ উইকেট মিরাজের রান তামিমের
পদ্মা সেতুর কারিগরি সৌন্দর্য্য সম্পর্কে বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোঃ শামসুল হক বলেন –
পদ্মা সেতুতে একটি অভিনব ও চমৎকার বিশেষত্ব হলো এতে কোন রেবেটিং নেই, সম্পূর্ণটা ঝালাই করা এবং এতে কেমিক্যালের কঠিন একটা স্তর দেওয়ার কারণে জং বা মরিচা ধরার কোনো সুযোগ নেই, আর ওজনটাও বেশ হালকা।
তিনি আরো যুক্ত করে বলেন – প্রযুক্তিগতভাবে আমরা কতটা এগিয়েছি সেটার পরিচয়ও বহন করে পদ্মা সেতু। এর নির্মাণকৌশল ও প্রযুক্তিগত দিক বিবেচনায় এটাকে বিজ্ঞানের আশীর্বাদই বলা যায়। সাধারণত আমাদের ব্রিজগুলোয় কংক্রিট ব্যবহৃত হয়। যেসব ব্রিজে লোহার রড থাকে সেগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়; তবে এ দ্বিতল সেতুতে দুটিরই ব্যবহার আছে।
তাই এটাকে একটা কম্পোজিট ব্রিজও বলতে পারেন । রডে নির্মিত স্থাপনাগুলোয় পানি পেলে রড ফুলে যায় এবং ক্ষয় হতে থাকে, সঙ্গে থাকা অন্য উপাদানেরও ক্ষতি হয়ে থাকে। সে জন্য সেগুলোর স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে মোটামুটি ১০০ বছর ধরা হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যারা পদ্মা সেতুতে প্রয়োগ করা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে সেখান থেকে জানা জানা যায়, এর স্থায়িত্ব ১০০ বছরের বেশি। তাই অবকাঠামোগতভাবে এটা বাংলাদেশের জন্য এক অসাধারণ অনন্য স্থাপনা।
পদ্মা নদীর গভীরতা কত জানেন? পানির প্রায় চল্লিশ মিটার অর্থাৎ ১৩১ ফিট নিচে নদীর তলদেশ। দশ ফিট করে এক তালার উচ্চতা হিসাবে পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে পানির পৃষ্ঠের উচ্চতা হল ১৩ তলা বিল্ডিংয়ের সমান।
বলা হয়ে থাকে আমাজনের পর সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা – স্রোতস্বিনী নদী পদ্মা। এখানে বর্ষায় এমন গতিতে স্রোত থাকে, যে কোনো প্রকৌশলগত কাজ করা জটিল হয়ে পড়ে। সে স্রোত সামলেই হয়েছে পদ্মা সেতুর কাজ।
পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে ছিলো চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির।এছাড়াও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে প্রায়২০টির বেশি বিভিন্ন দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের মেধা জড়িয়ে আছে।
পদ্মা সেতুর কারিগরি টিমের প্রধান ছিলেন সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার। তাঁর মৃত্যুর পর এই দায়িত্বে ছিলেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামীম জাহান বসুনিয়া।
কমিটিতে বাংলাদেশিদের মধ্যে ছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ ও পাইলিং বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হোসাইন মো. শাহীন।
আরেক সদস্য মাটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ এম এম সফিউল্লাহ গত বছর মারা যান ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল। বিদেশিদের মধ্যে জাপানের দুজন, ন্যাদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক এর একজন করে বিশেষজ্ঞ ।
পদ্মা সেতু বাঁকা কেন?
আকাশ থেকে পদ্মা সেতু দেখলে সামান্য বাঁকা দেখা যায় । প্রশ্ন হলো, পদ্মা সেতু অনুভূমিকভাবে বাঁকা কেন? এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক আনিসুল হক -তিনি বলেন , পদ্মা সেতু ৬.১৫ কি.মি. দীর্ঘ ।
এত লম্বা পথ সোজা হলে ড্রাইভিং এর সময় চালকের মনযোগ থাকবে না । একটু বাঁকা সেতুতে চালকদের হাত স্টিয়ারিংয়ের ওপরে থাকবে, মনোযোগও থাকবে গাড়ি চালানোর দিকে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা অনেক কমে যাবে।
তিনি আরো বলেন স্থলসড়কের তুলনায় সেতুর ওপরে দুর্ঘটনা অনেক বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে । দীর্ঘ সেতু অনুভূমিকভাবে একটু বাঁকা করে তৈরির কারণ হলো বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট সরাসরি যেন চালকের চোখে না পড়ে। তাতেও দুর্ঘটনার শঙ্কা কমে যাবে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাইফুল আমিন বলেছেন, পদ্মার তলায় মাটির বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য কিছু কিছু জায়গায় পাইল ড্রাইভ করতে গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার দিয়ে ড্রাইভ করেও ১২০মিটার বা ৪২০ ফুট অর্থাৎ ৪০ তলার মত নিচে শক্ত মাটি পাওয়া যায় নি । সেক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের নকশায় পরিবর্তন করে পাইলের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে।
পদ্মা সেতু স্টিল ট্রাসের হওয়ায় এর দীর্ঘস্থায়ীত্বের পাশাপাশি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। সেদিক দিয়ে এটি পরিবেশবান্ধব সবুজ উন্নয়ন। শুধু তাইনা ব্রিজের মধ্যে স্থাপিত ইলোকট্রনিক প্রযুক্তির মনিটরিং সেল ও সেল্ফ সেন্সর এর মাধ্যমে স্থাপনাটির স্বাস্থ্যগত কোনো পরিবর্তন ঘটছে কি না।
কোন জায়গায় কতটুকু চাপে আছে? ভূমিকম্প বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে কি না তা জানান দেবে। সংগত কারণেই এটার নির্মাণকৌশল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা একে টেকসই করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে । সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রযুক্তিগত কৌশলের জন্য পদ্মা সেতুর স্থায়িত্ব ১০০ বছরের বেশি হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ড.খান মাহমুদ আমানত বলেন – দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে বিশ্বে এমন অনেক সেতু থাকলে বেশ কিছু কারিগরি দিক দিয়ে গতি পরিবর্তনশীল খরস্রোতা নদীতে পদ্মা সেতু সত্যিই অনন্য।
প্রথমত এটায় বিশ্বের গভীরতম পাইলিং ফাউন্ডেশন ব্যবহৃত হয়েছে, দ্বিতীয়ত ভূমিকম্প প্রতিরোধী পেন্ডুলাম বিয়ারিং, তৃতীয়ত বিশ্বের বৃহত্তম নদী শাসন। পদ্মা সেতু আমাদের দেশের সম্পদ, জাতির সম্পদ, এটা আমাদের জন্য বিশেষ একটা কিছু, এটার যথাযথ ব্যবহার আমাদের নিশিত করতে হবে।
আমাদের দেশি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই সেতুর কাজ সম্পন্ন হওয়ায় তাদের সকলের জন্য আমরা গর্বিত। এই লেখা উৎসর্গ করলাম পদ্মা সেতুর প্রকৌশলগত জটিলতা নিরসনে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের আমৃত্যু প্রধান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে। স্যারের বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করি।
সেতুর শেষ স্প্যানটিতে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি চীনা ভাষায় যা লিখে তার বাংলা অনুবাদ হলো ‘অতিযত্ন সহকারে নানা সমস্যা মোকাবিলা করে শিগগিরই আমরা এ সেতু বাস্তবে রূপ দেব। আমরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।’
তাদের সূরেই বলতে হয় নানা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, কারিগরি ও প্রাকৃতিক শত চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আমরা আবারও প্রমাণ করেছি আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। এই সক্ষমতা ও কল্যাণময় অসাধ্যকে সাধন করার জন্য ১৬ কোটি মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ এই কাজে নিয়োজিত সকল প্রকৌশলী, কর্মকর্তা – কর্মচারীদের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।
লেখক – তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
সভাপতি – সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ইবাংলা/জেএন /১৮ জুলাই,২০২২