চীনে পদ্মফুলের অর্থনীতি প্রসারিত হচ্ছে

শিশির বেইজিং :

 

আমার জন্মস্থান শান তুং প্রদেশের চিনান শহর। শহরটির কেন্দ্রে অবস্থিত তা মিং নামের বড় একটি হ্রদ রয়েছে। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে হ্রদে ফুটে উঠে অনেক পদ্মফুল।

প্রাচীনকালে কবি গুরু ও রাজা তা মিং হ্রদ অনেক পছন্দ করতেন বলে তার সুন্দর দৃশ্য নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। তাঁরা নিয়মিত এখানে এসে গ্রীষ্মকাল কাটাতেন। সবচেয়ে বিখ্যাত একটি কবিতায় চিনান শহরের বর্ণনা করা হয় এভাবে: চারদিকে পদ্মফুল আর তিন দিকে উইলো, পাহাড়ি শহরের অর্ধেকটাই হ্রদ।

আমিও ছোটবেলা থেকে পদ্মফুল অনেক পছন্দ করি। ছুটির সময়ে বাবা-মা আমাকে নিয়ে তা মিং হ্রদে গিয়ে নৌকা বিহার করতেন। নৌকায় ভেসে পদ্মফুলের কাছে গিয়ে বিশেষ এক ধরনের সু-গন্ধ পেতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এবং কাজ করতে বেইজিংয়ে এসেছি। তাই অনেক বছর ধরে তা মিং হ্রদে যাইনি। তবে আমার শহরটি এখনো পদ্মফুলের শহরই রয়ে গেছে। সেখানে পদ্মফুলের অর্থনীতিও প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

চিনান শহরের বাসিন্দাদের মতে, পদ্মফুল ছাড়া এখানে গ্রীষ্মকাল সম্পূর্ণ হয় না। তা মিং হ্রদে রয়েছে ৬.৭ হেক্টরের একটি পদ্মপুকুর। সেখানে বেশ কয়েক প্রজাতির পদ্মফুল ফুটে।

গেল বছর পুকুরে একই বৃন্তে ফুঠেছে জোড়া পদ্মফুল। চীনের সংস্কৃতিতে এমন ফুল খুব কম দেখা যায় এবং তা সৌভাগ্য ও মানুষের মধ্যে সুসম্পর্কের প্রতীক। তাই এই জোড়া পদ্মফুল ইন্টারনেটে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তা মিং হ্রদ পার্কের দোকানে এ ফুলের আকারের নানা স্মারকও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

অন্যদিকে, চিনান শহরের উপকণ্ঠে কৃষকরাও পদ্ম চাষের মাধ্যমে অর্থনীতির উন্নয়ন করছেন। চিনান শহরের হ্য লৌ নামের একটি গ্রামের কৃষক হো ছিং লিয়াং প্রায় ৩ .৫ হেক্টর পুকুরে পদ্মফুল চাষ করেন। প্রতিবছর এ সময়ে হালকা গোলাপি রঙের ফুল যেমন পর্যটকদেরকে আকষর্ণ করে, তেমনি তাদের ঐহিত্যিক ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

শান তুং প্রদেশের আরেকটি জেলা চাও-তে গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছে চলতি বছরের চতুর্থ পদ্মফুল ই-কমার্স উৎসব। চাও জেলায় উন্নত হচ্ছে পর্যটন শিল্প এবং ১০৫ কোটি ইউয়ান দিয়ে তৈরি একটি জলাভূমি পার্কে চাষ করা হয়েছে ১০০ ধরনের পদ্মফুল এবং এর মধ্যে ৬০ ধরনের পদ্মফুল বিরল প্রজাতির।

যখন পদ্ম নগরের কথা আসে, অনেক চীনা মানুষের মনে উইশান হ্রদের কথা ভেসে ওঠে। এ হ্রদও শান তুং প্রদেশে।

ষাট বর্গকিলোমটার হ্রদে রয়েছে ৮,৬০০ হেক্টরের বেশি বন্য লাল পদ্ম এবং ৩০ বর্গকিলোমটার নলখাগড়া। এটি সারা পূর্ব চীনের সবচেয়ে আদিম ও সুন্দর একটি জায়গা। এটি পদ্মফুল উপভোগের জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান।

শান তুং প্রদেশের আরেকটি শহর হলো চি নিং। ২০১৫ সাল থেকে সেখানে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় থাই পাই হ্রদ পদ্মফুল উৎসব। থাই পাই হ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায়, পদ্মফুল দেখা যায়। এখানে ৭৬ ধরনের পদ্মফুল আছে এবং প্রতিবছর স্থানীয়রা এখানে এসে পদ্মফুল দেখে বা বাছাই করে।

অনলাইন কেনাকাটা চীনে আর কোন নতুন জিনিষ নয়। তবে অনলাইনে তাজা ফুল ক্রয় করা বিশ্বে খুব বেশি দেখা যায় না। উন্নত কোল্ড চেইন এবং পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্যে তা বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।

চীনের চিয়াং সু ও আন হুইসহ নানা প্রদেশে চাষ করা হয় পদ্মফুল এবং পদ্মফুলের বীজ ও মূল সবই খাওয়া যায়। তাই কৃষি, পর্যটন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণসহ তিনটি শিল্পের একসাথে উন্নয়ন হচ্ছে।

গত ২৯ জুন চে চিয়াং প্রদেশের চিয়ান ত্য শহরে ১৪তম চিয়ান ত্য পদ্মফুল উৎসব শুরু হয়। এখানে বিক্রি হয় বিশেষ একটি পারিবারিক প্যাকেজ।

প্যাকেজে রয়েছে পদ্মফুল,পদ্মপাতা, পদ্মবীজসহ নানা পণ্য। আর পাশাপাশি অনুষ্ঠানটি অনলাইন লাইভে প্রচারিত হয়। দর্শকরাও অনলাইনে প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন। ১০ হাজারের বেশি দর্শক এ অনুষ্ঠান অনলাইনে দেখেছেনে এবং শতাধিক অর্ডার করেছেন।

শান তুং প্রদেশের রি চাও শহরের চাং লিন মিয়াও একটি ফুল সমবায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি জানিয়েছেন, জুন মাস থেকে প্রতিদিন তিনি ১০ হাজারের বেশি পদ্মফুল বিক্রি করেন। একটি ফুলের দাম ৩.৪ ইউয়ান এবং বিনামূল্যে তা ক্রেতার বাড়িতে পাঠানো হয়। তার পদ্মফুল নানা হ্রদ থেকে সংগ্রহ করা হয়। যেমন: চিয়াং সু, হুপেই ও হ্য পেই প্রদেশের নানা হ্রদ। প্রতিদিন ভোর তিনটায় তার কর্মীরা পদ্মফুল বাছাই শুরু করেন এবং ক্রেতার ঠিকানা অনুযায়ী ফুল পাঠান।

কোন কোন ফুলের দোকান পদ্মফুল ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী ফল দিয়ে একটি তোড়া তৈরি করে এবং তাতে গ্রীষ্মের অনুভূতি ফুটে ওঠে। ভোজে এমন তোড়াও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অবশ্যই এমন তোড়ার দামও সাধারণ ফুল বা ফলের তোড়ার তুলনায় অনেক বেশি হয়।

পুকুরের পদ্মফুল ছিল আমার শৈশবের স্মৃতি। আর এখন তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফলে আরও বেশি মানুষ পদ্মফুলের মাধ্যমে সুখী হচ্ছে।সূত্র: সিএমজি

ইবাংলা/মশিউর /২৪শে জুলাই, ২০২২

Contact Us