বর্তমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি দিয়ে সমালোচনার শিকার হয়েছেনদেশ ও দেশের বাইরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি গত ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে যাবে। শেখ হাসিনার সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্ষমতার উৎস জনগণ, বাইরের কেউ ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে ‘কোনো অনুরোধ করা হয়নি’।
তিনি বলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে অনুরোধ করতে ‘সরকারের কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ভারত সফরে গিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলে থাকলে, তা তার ‘নিজস্ব বক্তব্য’।
আরও পড়ুন…তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে ১৫ আগস্ট স্মরণে শনিবার আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দলের কেউ না বলে মন্তব্য করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দলের কেউ না’-এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দল বিব্রত কি না? সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি সাংবাদিকদের বলেছি উনি দলের এমন কোনো নেতা নন, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ নন যে তিনি আওয়ামী লীগের পলিসি সম্পর্কে কথা বলতে পারেন। তাই তার কথার দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নিতে পারে না।’
এদিকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ-সদস্য অবশ্যই। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তো কেউ নন। যেহেতেু কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ নন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে বিদেশে গিয়ে কিছু বলা, সে দায়িত্ব আওয়ামী লীগ কাউকে দেয়নি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমার মনে হয় উনাকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে) জিজ্ঞাসা করেন। পত্রিকায় দেখিছি, ওনার বক্তব্যের অডিও ক্লিপও আছে। উনি যদি এটা (ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সহযোগিতার কথা) বলে থাকেন, তাহলে এ কথার মাধ্যমে কী বোঝাতে চেয়েছেন, এটা জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। উনার এই ব্যাখ্যাটুকু জনগণকে জানানো উচিত।
আনিসুল হক বলেন, আমি তো অবশ্যই আমার সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কিছু বলি না। কেউ যদি সেটা করেন তবে সেটি তার ব্যক্তিগত বক্তব্য হতে পারে। কোনোভাবেই সেটি দল বা সরকারের কথা হয় না। আর তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) তো আমাদের সঙ্গে আলাপ করে এ বক্তব্য দেননি।
অন্যদিকে পদত্যাগ দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আব্দুল মোমেনকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এরশাদ হোসেন রাশেদ। সাম্প্রতিক ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
রবিবার (২১ আগস্ট) রেজিস্ট্রি ডাকযোগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. এরশাদ হোসেন রাশেদ এ নোটিশ পাঠান।
নোটিশে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আপনি ভারত সরকারকে যে অনুরোধ করেছেন, এটা আপনি করতে পারেন না। কারণ, সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। আপনি সংবিধানবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি মন্ত্রী পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এ অবস্থায় নোটিশ প্রাপ্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপনার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় আপনার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব।
গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্যের এমন বক্তব্যে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগের কেউ না হলে ড. মোমেন আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন কীভাবে? আওয়ামী লীগের কেউ না হলে তাকে কেন এই দায়িত্ব দেয়া হলো? তিনি আওয়ামী লীগের না হলে তিনি তাহলে কার?
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মোমেনকে দলের লোক হিসেবে অস্বীকার করলেও রেকর্ড কিন্তু তা সমর্থন করছে না। কারণ কূটনীতি থেকে রাজনীতিতে আসা মোমেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। পরে তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথম সদস্য হন। নগর আওয়ামী লীগের এই কমিটি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনুমোদনেই হয়েছে।
আরও পড়ুন…এশিয়া কাপের লড়াইয়ে বড় রানের আভাস দিয়ে শেষ হলো প্রস্তুতি
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব থাকাকালেই সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ১৫ নং ওয়ার্ডের কার্যকরী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন ড. একে আব্দুল মোমেন। তখন অবশ্য সিলেটের রাজনীতিতে তিনি পদার্পণ করেননি। রাজনীতিতে আসবেন, আসছেন- এমন গুঞ্জন ছিল। ওই সময়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ওই ওয়ার্ড কমিটিতে তাকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আর এটি ছিল ড. একে আব্দুল মোমেনের আওয়ামী লীগের প্রথম পরিচয়। ২০১৫ সালের ২৬শে অক্টোবর ঘোষিত ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন মকসুদ বখত ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হাজী এম এ মতিন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, ওই সময়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আসাদ উদ্দিন আহমেদ।
তাদের অনুমোদন দেয়া কমিটিতে প্রথম সদস্য ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও প্রয়াত ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ ছাড়া কমিটির তৃতীয় সদস্য ছিলেন ড. এ কে আব্দুল মুমিন। ওই কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সিলেটের আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে পা বাড়ান ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে জাতিসংঘের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে সিলেটে ফিরেন ড. মোমেন।
ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতারাও তাকে সাদরে বরণ করে নেন। এরপর ২০১৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর সিলেট আওয়ামী লীগকে নতুন করে গড়ে তুলতে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনের মাধ্যমে সিলেট আওয়ামী লীগে আমূল পরিবর্তন করা হয়। পুরাতনদের বাদ দিয়ে নতুনদের দিয়ে গঠন করা হয় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি।
এর মধ্যে মহানগরের সভাপতি করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ উদ্দিন আহমদকে ও সাধারণ সম্পাদক হন জাকির হোসেন। তাদের দু’জনকে দিয়ে কমিটি গঠনের পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয় ২০২১ সালের ৮ই জানুয়ারি। কেন্দ্র অনুমোদিত ওই কমিটির প্রথম সদস্য হচ্ছেন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এখনো তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথম সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন। দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, জেলা ও মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় জেলার প্রথম সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছিল সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে ও মহানগরে রাখা হয় এ কে আব্দুল মোমেনকে।
এদিকে ভারতকে নিয়ে বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা পরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে একটু সহনশীল হওয়ার অনুরোধ করেছেন।
শুক্রবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের পক্ষে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন।
জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ‘আজ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশবাসী স্তম্ভিত । সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার সুগভীর ও দীর্ঘমেয়াদী ব্লু প্রিন্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ করায় জাতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।’
আরও পড়ুন…রাজধানীর শ্যামলী থেকে জেএমবি’র এক সদস্য গ্রেফতার
হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, এ ধরনের বক্তব্য তাদেরকে চরমভাবে বিব্রত করেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এই বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত।বিশ্লেষকরা মনে করেন,পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শেখ হাসিনা সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য চরম বিব্রতকর। সরকার এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে দলটির সিনিয়র একাধিক নেতা জানিয়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, এ ধরনের বক্তব্য তাদের জন্য বিব্রতকর।
এখন তাঁর বক্তব্য নিয়ে তোলপাড়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভাষায়, জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে আসা এ কে আব্দুল মোমেন ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছেন। তিনি তাঁর বড় ভাই প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সহায়তা নিয়ে সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন। পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই স্পর্শকাতর দায়িত্বে ও গুরুত্বপূর্ণ পদে তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। এর পর থেকে তিনি মুখে যা আসছে, তা-ই বলছেন। নানাভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। আপত্তিকর ও বিস্ম্ফোরক মন্তব্য করে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। বিরক্তির কারণও হয়েছেন।
তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত বর্তমান সংকটের মধ্যে তিনি কয়েক দিন আগে দেশের মানুষ বেহেশতে আছে বলে ব্যাপক সমালোচিত হন। আর এ জন্য তিনি গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে তুমুল সমালোচনার জন্ম দেন। এবারও তিনি গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যাওয়ার কথা। এর আগে ভারতকে জড়িয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিব্রতকর মন্তব্য নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাই তিনি কেন এমন অসংলগ্ন বক্তব্য দিলেন, এর কারণ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। নাকি ইচ্ছে করে সরকারকে বিপাকে ফেলা- সব কিছুই নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিব্রতকর হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। তাঁরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অতিকথন, রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও আত্মসম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ইবাংলা/জেএন/২২ আগস্ট,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.