সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধভাবে কিডনি কেনা-বেচা করে সংঘবদ্ধ চক্রটি। তারা প্রতিটি কিডনি বিক্রি করতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায়। এখানে ডোনারদের দেওয়া হতো মাত্র দুই লাখ টাকা। প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনি বেচা-কেনার এই চক্রটির অন্যতম হোতাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গতকাল সোমবার মধ্যরাত থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত র্যাব-৫ ও র্যাব-২ এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার যৌথ অভিযানে জয়পুরহাট এবং রাজধানীর নর্দা হতে কিডনি ক্রয়-বিক্রয় এই সিন্ডিকেটের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ (৩৬), মো. মেহেদী হাসান (২৪), মো. সাইফুল ইসলাম (২৮), মো. আব্দুল মান্নান (৪৫) এবং মো. তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু (৩৮)।
আজ দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজার বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও ডোনারদের আকৃষ্ট করে কিডনি কেনা-বেচার কাজ করে। তারা প্রতিটি কিডনি বিক্রি করেন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায়। কিন্তু দুই লাখের বেশি পেতো না ডোনাররা!
খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তার অভিযানে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট এবং ভিসা সম্পর্কিত বেশ কিছু কাগজপত্র, পাঁচটি মোবাইল এবং দেশী-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, চক্রটির মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন এবং তারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবৈধ এই কিডনি ক্রয়-বিক্রয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। চক্রের ১ম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। চক্রের ২য় দলটি ১ম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।
পরবর্তী সময়ে ৩য় অন্য একটি গ্রুপ ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।
র্যাব জানায়, এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ডোনারকে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে বৈধ/অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা এই চক্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগীদের নিকট হতে ১৫ হতে ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করতো। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে দুই লাখ টাকা প্রদান করতো। পরে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের চুপ রাখার চেষ্টা করা হতো।
চক্রের মূলহোতা ও অন্যতম আসামি শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ সম্পর্কে র্যাব জানায়, ইমরান পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং অনলাইনের মাধ্যমে আগ্রহী বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা হতে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন। ইমরান ফেসবুক এ দুটি পেজের অ্যাডমিন এবং এ পর্যন্ত তিনি কিডনি বিক্রয়ের জন্য প্রায় শতাধিক মানুষকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছেন।
র্যাব সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার চক্রের অন্যতম আসামি মো. আব্দুল মান্নান মূলত ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এই অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করেন এবং এর আগেও এই অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টির অধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত এই চক্রটি কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের পার্শ্ববর্তী দেশে কিডনি চিকিৎসায় সহায়তার নাম করে, অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে কিডনি প্রতিস্থাপনে উৎসাহিত করে। কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানের আড়ালে তারা এই ভয়ঙ্কর কিডনি কেনা-বেচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছিল বলেও জানায় র্যাব।