অক্টোবর মাসে চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত এলাকার কাশগর শহরের পাহাতকরি উপজেলার শোরবাগ গ্রামে ধান কাটা শুরু হয়। তখন সর্বত্র ফসল কাটা এবং মাড়াই মেশিনের কোলাহল শোনা যায়। এখানে প্রতিহেক্টর জমিতে ৭৫০০ কেজি ধান ফলে। একে সামুদ্রিক ধান বলে ডাকা হয়।
আপনারা হয়তো ভাবছেন, সিনচিয়াং একটি ভূ-বেষ্টিত এলাকা। এখানে কি সমুদ্র আছে? থাকলেও কি সমুদ্রে ধান চাষ হতে পারে? আমি বিস্তারিত ব্যাখা দিচ্ছি।
আরও পড়ুন…জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকাররে বিশ্বাস করি না
সামুদ্রিক ধান হল লবণাক্ততা সহনশীল ধানের একটি ছোট নাম। এ ধান সমুদ্র সৈকতসহ লবণাক্ত জমিতে বেঁচে থাকতে পারে। সামুদ্রিক ধান সমুদ্রে চাষ হয় না। কেবল স্বল্পমেয়াদী সমুদ্রের জলে নিমজ্জন সহ্য করতে পারে এবং নির্দিষ্ট মাত্রার লবণাক্ত জমিতে চাষ হয়।
সাধারণ ধানের তুলনায় সামুদ্রিক ধানের নানা সুবিধা আছে। যেমন: সাধারণ ধান মাত্র সমতল ভূমি, পাহাড়সহ মিঠা পানি এলাকায় চাষ হতে পারে এবং বন্যা প্রতিরোধ দক্ষতা খুবই কম। কিন্তু সামুদ্রিক ধান পরিবেশের সঙ্গে আরও সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। লবণ-ক্ষার প্রতিরোধ, কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ও বন্যা প্রতিরোধে বেশ পারঙ্গম তারা।
সাধারণ ধানের তুলনায় সামুদ্রিক ধান গাছের উচ্চতা বেশি। প্রায় ১.৮-২.৩ মিটার উঁচু। সাধারণ ধানের ২-৩ গুণ বেশি। সমুদ্রের জল সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ হয় বলে সামুদ্রিক ধান থেকে পাওয়া চালের রঙ হালকা লাল হয়। তা সাধারণ চালের চেয়ে ভিন্ন হয়। সাধারণ চালের তুলনায় এ চাল আরও বেশি পুষ্টিকর।
মোট ১০০ গ্রাম সাধারণ চালে প্রোটিনের পরিমাণ ৬.৭ গ্রাম, আর সামুদ্রিক চালে রয়েছে ফ্যাট, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও প্রোটিনসহ নানা পুষ্টি উপাদান এবং প্রতি ১০০ গ্রামের চালে রয়েছে ১৪.৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৭.৬ মিলিগ্রাম সোডিয়াম ও অর্ধেক গ্রাম ফ্যাট।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, সামুদ্রিক ধান খেতে সুস্বাদু এবং নরম। অনেক মানুষ এ চাল সাধারণ চালের তুলনায় আরও সুস্বাদু মনে করে। এ চালে কোন নোনতা এবং সমুদ্রের গন্ধ নেই। তবে, সামুদ্রিক ধানকে সমুদ্রের পানি দিয়ে সেচ দেওয়া যায় না, বরং মিঠা পানির সেচ দিতে হয়।
২০১৮ সালে চীনের হাইনান প্রজনন কেন্দ্র হাজার হাজার সামুদ্রিক ধানের নমুনা থেকে ১৭৬টি সেরা ধান বাছাই করে এবং চীনে প্রথমবারের মতো বড় আকারের সামুদ্রিক ধান চাষের পরীক্ষা শুরু করে।
২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত লবণাক্ততা সহনশীল ধান গবেষণা ও পরীক্ষা পর্যায় থেকে বড় আকারের চাষের পর্যায়ে এসেছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ৮টি প্রজাতির সামুদ্রিক ধান জাতীয় লবণ এবং ক্ষার প্রতিরোধের সার্টিফিকেট লাভ করে। এখন চীনে মোট ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সামুদ্রিক ধান চাষ হয়। হেইলংচিয়াং, শান তুং, লিয়াও নিং, ইনার মঙ্গোলিয়া, চেচিয়াং, চিয়াংসু, শ্যানসি ও সিনচিয়াংসহ ১০টি প্রদেশ ও এলাকার ৪ ধরনের লবণাক্ত জমিতে এসব ধান চাষ হয়।
শান তুং প্রদেশের ওয়ে ফেং শহরের একজন কৃষক চেন রু মিন জানিয়েছেন, স্থানীয় লবণাক্ত জমিতে আগে কোন ফসল হত না। তবে এখন সামুদ্রিক ধান চাষ হবার পর প্রতিহেক্টর জমিতে ৯০০০ কেজি ধান ফলে। শান তুং প্রদেশর বোহাই বেইতে অবস্থিত ব্যাপক পরিত্যক্ত লবণাক্ত জমি এখন সামুদ্রিক ধান চাষে ব্যবহার করা হয়। শুরুতে ৬৭ হেক্টর জমিতে পরীক্ষামূলক চাষ হত। আর এখন চাষের আয়তন ৩৮৬৭ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে।
চীনে খাদ্য উৎপাদন ও লবণাক্ত জমি ব্যবহারের উপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। স্থানীয় সরকার ও গবেষণালয় সামুদ্রিক ধান ক্ষেতে বেশ বিনিয়োগ ও কেয়ার করে। জানা গেছে চলতি বছর চীনে সামুদ্রিক ধান চাষের আয়তন ৬৬ হাজার হেক্টর হবে।
আমরা শুরুতে সিনচিয়াংয়ের কাশগরের ওই গ্রামের গল্প বলেছি। সবাই এখন বুঝতে পেরেছেন সিনচিয়াংয়ে কোন সমুদ্র না থাকলেও লবণাক্ত জমি আছে। সামুদ্রিক ধান শুধু লবণাক্ত জমিতে বেঁচে থাকতে পারে তা নয়- বরং তা লবণ শোষণ করে মাটির মান উন্নত করতে পারে। চার বছরের মতো সামুদ্রিক ধান চাষ হবার পর লবণাক্ত জমিতে লবণের অনুপাত অনেক কমে যায় এবং উচ্চ ফলনশীল ক্ষেতে পরিণত হয়। চলতি বছর সিনচিয়াংয়ে প্রতিহেক্টর জমিতে সামুদ্রিক ধানের উৎপাদন পরিমাণ ৭৫০০ কেজি হবে।
শোরবাগ গ্রামের বাসিন্দা মুহতার জানিয়েছেন, তার ০.৮ হেক্টর জমি কোম্পানির কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এ থেকে তিনি প্রতিবছর ৯০০০ ইউয়ান পেতে পারেন। পাশাপাশি, তিনি কোম্পানিতে কাজ করেন। তার পরিবার ধান ক্ষেতে ৬০টি হাঁস লালন করে এবং একসাথে প্রতিবছর ৫০ হাজার ইউয়ান উপার্জন করতে পারে।
আরও পড়ুন…আকিকা না করলে কি গুনাহ হয় ?
সামুদ্রিক ধান চাষের মাধ্যমে পাহাতকরি উপজেলা একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন করেছে। অন্যদিকে, স্থানীয়দের আয় বৃদ্ধি করেছে। ধান ক্ষেত-ভিত্তিক পর্যটনও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সামুদ্রিক ধানের সাহায্যে উপজেলাটি পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ লাভ করেছে। সূত্র : শিশির, সিএমজি।
ইবাংলা/জেএন/১০নভেম্বর ২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.