অবশেষে তিন বছর কারাভোগ করা আলোচিত সেই জাহালমকে বাদ দিয়ে পলাতক আসামি আবু সালেককে অন্তর্ভুক্ত করে ৩৩ মামলার চার্জশিট দিতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সব মামলায় জাহালমকে বাদ দিয়ে সালেকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের আসামি করা হচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, জাহালমের বিষয়টি আলোচিত। ৩৩ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। মূল আসামির নাম হচ্ছে সালেক। তাকে শনাক্ত করতে না পেরে জাহালমকে আসামি করা হয়েছিল। এরপর সে জেলও খাটে। বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে কোর্ট আমাদের পুনরায় তদন্ত করতে বলেন। আমরা তদন্ত করে জাহালম যে নির্দোষ তার সত্যতা পাই।
তিনি আরও বলেন, এরপর জাহালমকে বাদ দিয়ে আসল আসামি সালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে তদন্ত করছি। মামলার চার্জশিটে সালেককে আসামি করার পাশাপাশি জাহালমকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। আর কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন আসামি না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সালেককে গ্রেফতাররে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। যেখানেই থাকুক ধরা পড়ে যাবে।
দুদকের খাতায় পলাতক আবু সালেক ভারত কিংবা নেপালে রয়েছে। এ বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালের শুরুতে ভুল আসামি হিসেবে জাহালমের ঘটনা বের হওয়ার পরই আবু সালেক দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তাকে গ্রেফতার করতে তার আত্মীয়-স্বজনদের অন্তত ২০-২৫টি মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিং করেছি, বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিয়েছি। তবে তাকে এখনো পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন…ভিডিও-লিঙ্কের মাধ্যমে তৃণমুলের কর্মী ও জনগণকে সি চিন পিংয়ের শুভেচ্ছা
দুদক ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিসের তৎকালীন ডিজিএম এ কে এম সাজেদুর রহমান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় ২০১০ সালে প্রথম মামলা দায়ের করেন।
যেখানে সোনালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ১৮টি ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়ায় জাল-জালিয়াতির বিষয়টি প্রাথমিকভাবে উদঘাটিত হয়। এর কিছুদিন পরে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে।
জাহালমের মামলার অন্যতম প্রধান আসামি মো. আমিনুল হক সরকারকে ২০১৯ সালের আগস্টে গ্রেফতার করেছিল দুদক। এই প্রতিবেদনই দুদকে পাঠানো হয়। যার ওপর ভিত্তি করেই অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পরবর্তীতে ২০১২ সালে তৎকালীন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে ৩৩টি মামলা করা হয়।
কিন্তু তদন্তকালে ঠাকুরগাঁওয়ের সালেকের বদলে টাঙ্গাইলের জাহালমকে আসামি করা হয়। আসামি হিসেবে তাকে আবু সালেক ওরফে জাহালম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফলে সালেকের স্থলে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বছর কারাগারে কাটাতে হয় টাঙ্গাইলের জাহালমকে।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি হিসেবে জেলে থাকার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি ও মামলার বাদীসহ চার জনকে তলব করেন হাইকোর্ট। একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে’ ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনা হয়।
প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি নিরীহ জাহালমকে দুদকের সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওই দিনই মুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ভুল তদন্তের জন্য জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই দিনই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম। এরপর বিচারিক আদালত থেকে ওই সব মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সাড়ে তিন বছর পর সব মামলা থেকে জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করতে তদন্তের দায়িত্বে থাকা ৯ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয় দুদক।
ঢাকা বিচারিক আদালতে দুদকের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘৩৩টি মামলা অধিকতর তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। সেই তদন্ত রিপোর্ট জমা হবে শিগগিরই। জাহালমকে যারা চিহ্নিত করেছিলেন তা তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিজের ইচ্ছায় করেননি, ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে এমনটা হয়েছিল। ব্যাংক থেকে চিহ্নিত করে দিয়েছিল জাহালমকে। এখন আসল আসামি আবু সালেককে চিহ্নিত করে চার্জশিট দেওয়া হবে।’
এ ঘটনায় দুদকের তদন্তকালে জাহালমের মামলার অন্যতম প্রধান আসামি মো. আমিনুল হক সরকার ওরফে মো. আমিনুল হক ওরফে হক সাবকে ২০১৯ সালের আগস্টে গ্রেফতার করেছিল দুদক। সংঘবদ্ধ জালিয়াত ও প্রতারক দলের অন্যতম এই হোতা দুদকের ৩৩টি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। গ্রেফতার হওয়ার পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড থেকে আত্মসাৎ করা ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা লোপাট করার কথা আমিনুল স্বীকার করেছিলেন।
আরও পড়ুন…শহীদ জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী পালিত
এদিকে বিনা দোষে কারাভোগের কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে এক রিটের শুনানি শেষে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ব্র্যাক ব্যাংককে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৫ আগস্ট এ রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে ব্র্যাক ব্যাংক। পরে ৫ লাখ টাকা জাহালমকে পরিশোধের শর্তে চেম্বার জজ ওই রায় স্থগিত করেন। এরপর গত ১ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার জাহালমের বড় ভাই শাহানুরের হাতে তুলে দেয় ব্র্যাক ব্যাংক।
ইবাংলা/জেএন/১৯ জানুয়ারি, ২০২৩
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.