কুমিলস্নার নানুয়া দীঘিরপাড় পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ রাখার ঘটনায় সরাসরি অংশ নেওয়া ইকবাল হোসেনকে কে বা কারা এ অপকর্মে উদ্বুদ্ধ করেছে, এর নেপথ্যে তাদের দুরভিসন্ধি কী তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। খোঁজা হচ্ছে ওই ঘটনার আগে বেশ কয়েকদিন ইকবালের সঙ্গে মাজারে প্রায়ই আসা-যাওয়া ও ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করা অজ্ঞাত তিন ব্যক্তিকে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, মানসিক ভারসাম্যহীন, ভবঘুরে ও মাদকাসক্ত ইকবালকে এ অপকর্মে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য-উপাত্তও তাদের হাতে এসেছে। এসব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এছাড়া ১১ অক্টোবর দিবাগত গভীর রাতে ওই অপ্রীতিকর ঘটনার আগে তিন ব্যক্তি ৪-৫ দিন ইকবালের সঙ্গে মাজারে আসা-যাওয়া করত বলে তথ্য পেয়েছে তারা।
তবে ঘটনার পর তাদের আর এলাকায় দেখা যায়নি। স্থানীয়রা তাদের পরিচয়ও জানাতে পারেনি। এতে ওই ঘটনার সঙ্গে এ তিন ব্যক্তির সম্পৃক্ততা থাকার সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন ও আটকের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই তিন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে মাজার ও এর আশপাশের এলাকার প্রতিটি সিসি ক্যামেরার ৫ থেকে ১০ অক্টোবরের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দারা। এসব ফুটেজ পর্যালোচনা করে ইকবালের সঙ্গে মাজারে আসা-যাওয়া করা লোকজনের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। যা থেকে ঘটনার পর এলাকা থেকে সরে পড়া তিন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
পূজামন্ডপে কোরআন শরীফ রাখার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ জানায়, স্পর্শকাতর এ বিষয়টি তদন্তে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে যাতে কোনোভাবে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়া না হয় এ ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছেন। সরকারের ওপর মহল থেকেও তাদের এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই কিছুটা ধীরে হলেও প্রতিটি বিষয় নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখছেন তারা।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাদের ধারণা, ইকবাল কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ও মাদকাসক্ত হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে এ ভয়ংকর অপকর্ম করার জন্য বেছে নিয়েছে। তাকে মাদক কিংবা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হয়তো এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে। কারা কীসের প্রলোভন দেখিয়ে ইকবালকে এ ধরনের ভয়ংকর অপরাধে যুক্ত করেছে তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দারা আশাবাদী, কীসের বিনিময়ে ইকবালকে এ অপকর্মে উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছিল তা জানা গেলে ঘটনার রহস্য অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসবে।
তবে ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পূজামন্ডপে কোরআন শরীফ রেখে আসা এবং হনুমানের মূর্তির হাত থেকে গদা সরিয়ে নেওয়ার কথা ইকবাল নিঃসংকোচে স্বীকার করলেও কে বা কারা তাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে এখনো জানাননি। এমনকি ঘটনার আগে যে তিন ব্যক্তি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেছেন এবং একসঙ্গে মাজারে যাতায়াত করেছেন তাদের ব্যাপারেও তিনি কোনো তথ্য দিচ্ছেন না।
গোয়েন্দাদের তিনি বলছেন, স্থানীয়দের সঙ্গেই তিনি মাজারে আসা-যাওয়া করেছেন। অপরিচিত কারও সঙ্গে তার মাজারে যাতায়াত ছিল না। আবার কখনো বলছেন, বহিরাগত ২-৩ জন তাকে এটা-ওটা খাইয়েছেন, গাঁজা-ইয়াবাও দিয়েছেন। তার সঙ্গে ধর্ম-অধর্ম, মাজার-মন্দির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তবে তাদের চেহারা তার ভালো মনে নেই।
পূজামন্ডপের ঘটনার ছায়া তদন্তে সম্পৃক্ত পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর একটি সূত্র জানায়, তারা ইকবালের কাছ থেকে ওই তিন ব্যক্তির চেহারার বর্ণনা শুনে তাদের চেহারার স্কেচ তৈরির চেষ্টা করছে। সুষ্ঠুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করা গেলে তাদের চিহ্নিত করা যাবে। তারা স্থানীয় নাকি বহিরাগত এ বিষয়টিও পরিষ্কার হবে। এতে তদন্তের বড় এক ধাপ অগ্রগতি হবে।
এদিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এ ঘটনার নেপথ্যে মদদদাতারা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কি না তা খতিয়ে দেখছে। এ তৎপরতার অংশ হিসেবে তারা এ চক্রকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের এ মিশনে সন্দেহভাজন ওই তিন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জঙ্গি গোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্যের প্রোফাইল তাদের হাতে রয়েছে। ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা গেলে এ অপতৎপরতার নেপথ্যে কারণ দ্রম্নত নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এদিকে মাজারের দুই খাদেম ফয়সাল ও হুমায়ুনও এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি। তাদের ভাষ্য, মাজারে স্থানীয়দের পাশাপাশি বহিরাগত মানুষজনের আসা-যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক ঘটনা। তাই তারা এ বিষয়টি ততটা খেয়াল করেননি। এছাড়া ইকবালকে তারা মানসিক ভারসাম্যহীন ও মাদকাসক্ত বলে জানতেন। তাই তার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না।
খাদেম হুমায়ুন জানিয়েছেন, ঘটনার রাতে ইকবাল মাজারে এসে কোরআন শরীফ পড়তে চেয়েছিলেন। তাই তাকে তিনি মসজিদের তাকিয়া থেকে কোরআন শরীফ এনে দেন। তবে তা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে তিনি উঠে পড়েন। ইকবাল কোরআন শরীফ নিয়ে চলে যাওয়ার বিষয়টি তিনি দেখেননি। প্রায় একই ধরনের দাবি করেছেন মাজারের অপর খাদেম ফয়সালও।
এদিকে নানুয়া দীঘির পূজামন্ডপ ও মাজারসংলগ্ন স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। বিশেষ করে পূজামন্ডপে হামলার ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের কার কী ভূমিকা ছিল তা জানার চেষ্টা করেছেন তারা। তথ্য নিয়েছেন অভিযুক্ত ইকবাল, মাজারের দুই খাদেম ও জরুরি সেবা নম্বরে কল করা ইমরান সম্পর্কে।
তথ্য সংগ্রহকারী দলের একটি সূত্র জানায়, স্থানীয়রা প্রায় সবাই একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। ইকবাল দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত এবং কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানিয়েছেন তারা। ইমরানের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ জানিয়েছেন, মন্দিরে হামলাকারীদের একটি বড় অংশ বহিরাগত। তারা পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানোর আগে প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে এসেছিল। তাই তাদের হাতে লাঠিসোটা, মন্দিরের দেয়াল টপকানোর জন্য মই এবং কাঁধে ও পিঠের ব্যাগ ভরে রেললাইন থেকে পাথর নিয়ে এসেছিল।
স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের অভিযোগ, থানা পুলিশ যথেষ্ট সতর্ক থাকলে মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটত না। আর ঘটলেও প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশ তা সামাল দিতে পারত। তাতে এ ঘটনা এত দূর গড়াতো না। কারও কারও দাবি, এটি সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কোনো ষড়যন্ত্র নয়, এর নেপথ্যে অন্য কোনো পরিকল্পিত ভয়ংকর ছক রয়েছে।
কেননা স্থানীয়ভাবে সেখানকার হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আগে কখনো কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ বাধেনি। এমনকি মন্দিরে হামলার সময়ও অনেক মুসলমান ব্যক্তি তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। তাই মন্দিরে কে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখে এসেছে তাকে ধরেই আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে এর নেপথ্যে যড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন কেউ কেউ।
চট্টগ্রামের রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন জানান, অভিযুক্ত ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিগগিরই এ ঘটনার নেপথ্যে মদদদাতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।