দেশে সাড়ে চার বছরে গণপিটুনিতে মৃত্যু ২২৪

দেশে অবিশ্বাস্য হারে গণপিটুনিতে হত্যা বাড়ছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে হত্যা ৪১ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৯ সালে রেনু হত্যার পর এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা গেছেন ২২৪ জন। একে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার লক্ষণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এরই অংশ হিসাবে সর্বশেষ গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় গরু চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে দুইজনকে হত্যা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের নামিলা গ্রামে ও পাশের বড়িবাড়ি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, নিহত ওই দুইজনসহ কয়েকজন রাত ২টার দিকে গরু চুরি করতে নামিলা গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে যায়। বিষয়টি টের পেয়ে বাড়ির লোকজন চিৎকার করতে শুরু করলে এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে একজন মারা যায়। অন্যজন ধাওয়া খেয়ে ধান খেতে লুকালে ধরে এনে গণপিটুনির পর মারা যায়।

আরও পড়ুন>> ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা

সিংহশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার পারভেজ বলেন, এলাকায় গরু চুরি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারা চুরি ঠেকাতে এলাকায় পাহারা বসিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, রাতে গাড়িতে করে এক কৃষকের গরু চুরি করতে কয়েকজন এসেছিল। গ্রামবাসী বিষয়টি টের পেয়ে একজোট হয়ে দুইজনকে গণপিটুনি দিয়েছে। এতে তারা মারা যায়। খবর পেয়ে আমি পরে ঘটনাস্থলে যাই। কাপাসিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর মিয়া জানান, ওই দুইজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। তাদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

একইভাবে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বগির বিল এলাকায় ডাকাত সন্দেহে মাইকে ঘোষণা দিয়ে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত রবিবার রাত একটার দিকে এলাকার লোকজন মাইকে ঘোষণার পর জড়ো হয়ে তাদের গণপিটুনিতে হত্যা করে। নিহতদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত দেখা গেছে। কিন্তু এত ঘটনার পরও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় অনেক পরে। ফলে ততক্ষণে লাশ সরিয়ে ফেলা হয়।  পুলিশ কখন আসে ঠিক নাই: সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) জাকির হোসেন জানান, আসলে আমাদের এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ ছিলেন। এই এলাকায় প্রায়ই চুরি ডাকাতি হয়। তাদের (নিহত) অতীত রেকর্ড ভালো না। তাদের এলাকার লোকজন চিনে ফেলায়  মসজিদের মাইকে সবাইকে ডাকাত পড়েছে বলে আহ্বান জানালে লোকজন জড়ো হয়ে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। ফোনে ফোনেও খবর দেয়া হয়। নিহতদের শরীরে  ধারালো অস্ত্রেরও আঘাত আছে। তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আরেকজন হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যায়। তারা ওই উপজেলারই বাসিন্দা। দুজনের লাশ পরিবারের সদস্যরা গত মঙ্গলবার নিয়ে গেছে। আর দুজনের লাশ এখনো হাসপাতালের মর্গে আছে।

মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে পুলিশ জানায়। মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলায় লোকজন এসে তাদের হত্যা করে ওই এলাকার বাসিন্দা এমদাদুল হক জানান, ঘটনার দুইদিন আগে গতকাল শুক্রবার রাতে আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা আমার মায়ের গহনা এবং নগদ টাকা নিয়ে যায়। ডাকাতের আঘাতে আমার বাবা গুরুতর আহত হন। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ডাকাতের কারণে এলাকার লোক সতর্ক থাকেন। সন্দেহজনক এবং অপরিচিত কাউকে দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওইদিন তারা বিলের মধ্যে জড়ো হচ্ছিল বলে খবর পাওয়া যায়।। দুই-একজনকে আগেই এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।

পুলিশকে খবর না দিয়ে কেন নিজেরাই মাইকে ঘোষণা দিয়ে ঘেরাও করে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য জাকির হোসেন বলেন, পুলিশ কখন আসে না আসে তার ঠিক নাই। আগেও অভিযোগ দিয়ে কোনো কাজ হয়নি। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ বিল্লাল হোসেন বলেন, যারা নিহত হয়েছে তারা পেশাদার ডাকাত। তাদের নামে আগেও মামলা আছে।

তার ভাষ্য, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এবং আড়াইহাজার ডাকাতপ্রবণ এলকা। নদী, বিল ও দুর্গম এলাকা থাকায় ডাকাতরা সহজেই বিচরণ করতে পারে। ওইদিন তারা বিলের মধ্যে ডাকাতির জন্য জড়ো হচ্ছিল। এলাকার লোক টের পেয়ে তাদের ঘেরাও করে গণপিটুনি দেয়। তবে তাদের কাছ থেকে পুলিশ কোনো ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি।

ইউপি সদস্য জাকির হোসেন জানান, লাশগুলো দূরে দূরে ফেলে দেয়া হয়েছিল। পুলিশ সারারাত তল্লাশি করে লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে। এলাকার মানুষ ডাকাতদের উৎপাতে অতিষ্ঠ থাকায় তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। তবে শেখ বিল্লাল হোসেন দাবি করেন, ওই এলাকা ডাকাতপ্রবণ হলেও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক আছে। এলাকাটা থানা থেকে বেশ দূরে। তারপরও আমরা চেষ্টা করি পুলিশ টহলসহ নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে।

বাড়ছে গণপিটুনিতে হত্যা: ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তসলিমা বেগম রেনু নামে এক মাকে। তিনি একটি স্কুলে গিয়েছিলেন তার সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে। এরপর সাধারণ মানুষ গণপিটুনির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু তারপর পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে গেছে। কোনো ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বড় করে প্রকাশ হলে তা নিয়ে আলোচনা হয়। আরও অনেক গণপিটুনির ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে নেই কারো মাথাব্যথা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সারাদেশে গণপিটুনিতে ৯ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। ২০২২ সালে ৩৬ জন। ২০২১ সালে ২৮ জন। ২০২০ সালে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৫ জন, ২০১৯ সালে  ৬৫ জন। ওই বছর পদ্মা সেতুতে শিশুর রক্ত লাগবে, মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল। সেখান থেকেই ছেলেধরা গুজব তৈরি হয়। এরপর গত কয়েক বছরে এই ধরনের গুজব তৈরি না হলেও গণপিটুনি বন্ধ হয়নি। ২০১৯ সাল থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২২৪ জন।

সাড়ে চার বছরেও হয়নি রেনু হত্যার বিচার: রেনু হত্যাকাণ্ডের পর সাড়ে চার বছরের বেশি পার হয়ে গেলেও এখনো বিচার কাজ শেষ হয়নি। তার ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু জানান, এখনও সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি। এই ঘটনায় ১৫ জন আসামিকে  পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তাদের ১০ আদাললত থেকে জামিন পেয়ছেন। আর ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। এই ঘটনায় দুইটি আদালতে বিচার কাজ চলছে। আসামিদের দুইজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিচার চলছে নারী ও শিশু আদালতে।

নাসিরউদ্দিন টিটু বলেন, অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ায় এখন আর সাক্ষীদের আলাতে হাজির করা যাচ্ছে না। অনেকে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। আমি হতাশ। এই কারণে শেষ পর্যন্ত না মামলাটি আর ঝুলে যায়।  তার কথা, এই ধরনের ঘটনার দ্রুত  এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে গণপিটুনির ঘটনা অনেক কমে যেত।

কেন বাড়ছে গণপিটুনিতে হত্যা: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, গণপিটুনির ঘটনার আমরা কোনো বিচার হতে দেখি না। ফলে গণপিটুনিতে হত্যা থামছে না। আর এই ধরনের মামলায় শত শত আসামি হওয়ায় পুলিশও কোনো দায়িত্ব নেয় না। এখানে সরকারের কোনো স্বার্থ নাই। সেটা থাকলে পুলিশ শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করত।

তার মতে গণপিটুনি কয়েক কারণে ঘটে। প্রথমত, মানুষ যখন বিচার পায় না, অপরাধের প্রতিকার পায় না তখন আইন হাতে তুলে নেয়। এরপর গোষ্ঠীগত  স্বার্থে গুজব বা অপপ্রচারের মাধ্যমে গণপিটুনি হয়। আর কিছু লোক ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গণপিটুনিকে ব্যবহার করে। তার মতে তিনটি বিষয় দরকার, মানুষ যেন অপরাধের বিচার পায়। অপরাধী যাতে পার পেয়ে না যায়। তাহলে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না। আবার গণপিটুনিতে হত্যার মতো অপরাধ হলে তারও যেন বিচার  হয়। এর বাইরে গুজব, অপপ্রচার এটা বন্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের এখানকার মানুষের মধ্যে মব সাইকোলজি আছে। তারা কারুর ছোটখাটো অপরাধে দলবদ্ধ হয়ে তাকে নির্যাতন বা গণপিটুনি দেয়। এর কারণ হতে পারে ওইসব অপরাধ বেড়ে যাওয়া, পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। তবে সংঘবদ্ধভাবেও এই গণপিটুনি হয় পরিকল্পনা করে, গুজব ছড়িয়ে। যেটা আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় দেখেছি। আবার গ্রামে মোড়লরা সালিশি করেও এই ঘটনা ঘটায়। তখন সেটা হয় নির্মম ও ভয়ংকর। তিনি মনে করেন, গণপিটুনি বন্ধে মানুষকে সচেতন ও মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে। আর কোনো অপরাধের সময় পুলিশ যদি ঠিক সময়ে সক্রিয় হলেও তা কাজে দেয়। তবে এত মানুষের দেশে সেটা কতটা সম্ভব সেটাই ভাবার বিষয়। ফারুখ ফয়সালের মতে, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়া খারাপ লক্ষণ। এতে বোঝা যায় মানুষ পুলিশ ও বিচারের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। আবার মানুষ মানুষের প্রতি অমানবিক হচ্ছে।

ইবাংলা/এসআরএস

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.

Contact Us