ইউপি নির্বাচনে মাদক ও হত্যা মামলার আসামীরা

আমিনুল ইসলাম,ঢাকা

ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধি হতে মরিয়া হত্যা মামলার আসামী ও মাদক ব্যবসায়ীরা।তাদের  দৌড়াত্বে অসহায় শিক্ষিত,সৎ ও নীতিবান প্রার্থীরা। বড় দল বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করায় দুর্নীতিবাজ,মাদক ব্যবসায়ী ও মামলার আসামীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বগুড়ায় একাধিক ইউনিয়নে হত্যা ও মাদক মামলার আসামীরা আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেতে তদবির করছেন। ইতিমধ্যে ২য় ধাপের ঘোষিত তফসিলের পর কয়েকটি ইউনিয়নে বিতর্কিতরা মনোনয়ন পেয়েছেন। এসব নিয়ে মাঠ পর্যায়ে আওয়ামীলীগের তৃনমুল নেতাকর্মিদের মেধ্য অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

জেলার গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান আলতাব হত্যা মামলার প্রধান আসামী। আলতাবের ইটভাটার কর্মচারী আশরাফ আলীকে ২০১৩ সালের ১৪ জুন রাতে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও মূখের ভিতর বিষ ঢেলে দিয়ে হত্যা করেন। এ হত্যার ঘটনায় পরের দিন আলতাবকে প্রধান আসামী করে ৯ জনের বিরুদ্ধে গাবতলী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের পরিবার।

হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী আলতাবের বাড়ী-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ইটভাটা গুড়িয়ে দেয়। এ মামলায় আলতাবকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় সে সময়কার গাবতলী মডেল থানার এসআই আনোয়ার হোসেন। পরে মামলার তদন্ত শেষে আলতাবকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। মামলাটি বিচারাধীন আছে এবং আলতাব উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।হত্যার এক বছর আগে আলতাব সোনারায় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন।

অপরদিকে বগুড়ার সদর উপজেলার সাবগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ইসরাইল হোসেন একটি হত্যা মামলার অন্যতম আসামী। ওই ইউনিয়নের উদ্দিগোলা বাজারে ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশ্যে দিনের বেলায় আব্দুর রহিম সরকার নামে এক আওয়ামীলীগ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ

ঘটনায় নিহতের ভাই আব্দুল বাসেদ সরকার বাদী হয়ে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে ১৭ জনের নামে বগুড়া সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার অন্যতম আসামী করা হয় সাবগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ইসরাইল হোসেনকে। এ মামলায়ও ইসরাইল হোসেনকে অভিযুক্ত করে চাজশীট দেয় পুলিশ। ইসরাইল হোসেন জামিন নিয়ে এলাকায় জনসংযোগ করছেন।

জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটশেরপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এফাজ উদ্দিন একটি খুনের মামলার অন্যতম আসামী। জানা গেছে,ওই ইউনিয়নের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী ফজলুল করিম শেখ ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল খুন হন।

এ খুনের ঘটনায় নিহতের পরিবার থেকে যাদেরকে আসামী করা হয় সেখানে এফাজ উদ্দিনের নাম ছিলনা। এ খুনের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি এফাজ উদ্দিনের সম্পৃক্ততা পান। সিআইডির ওসি শামসুল আলম মামলার তদন্ত শেষে এফাজ উদ্দিনকে অভিযুক্ত করে ২০১৯ সালের ৫ আগষ্ট আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। তিনি ইউপি নির্বাচন করতে মরিয় হয়ে উঠছেন।

একই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাধারণ সম্পাদক আল ওয়াকি শিলু একটি মাদক মামলার আসামী। তাকে ইয়াবাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ মামলায় ২৩ মে ২০১৯ সালে রায় হয়। রায়ে আল ওয়াকি শিলুর এক বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে তিনি মামলার রায়ের বিষয়ে আপিল করেছেন। তিনিও দলীয় মনোনয়নে চেয়ারম্যান হতে চান।

ধুনট উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদ্য বহিস্কৃত ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এম এ তারেক হেলাল মাদক মামলার আসামী। ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা হয়। তিনিও আওয়ামীলীগের মনোনয়ন চাইছেন। একই উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মুর্ত্তজা একটি মাদক মামলার আসামী। ২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা হয়। তিনিও দলীয় মনোনয়ন পেতে তদবির করছেন।

এছাড়া জেলার শিবগঞ্জ ও শেরপুর উপজেলায় ২০টি ইউনিয়নে যাদেরকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তাদের অনেকেই হত্যা,সরকারী মানবিক সহায়তার টাকা ও সরকারী গাছ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। এরা মনোনয়ন পাওয়ায় স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ।

কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে টেকনাফে ১২ তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়েছেন। আাগামীকাল ১১ নভেম্বর নির্বাচনে জয়ী হতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। এদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই মাদকের মামলা রয়েছে । ইয়াবাসহ তাদের অনেকেই কয়েক দফা মাদকসহ গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক ব্যবসায়ী এবং পৃষ্টপোষক প্রার্থীদের টার্গেট যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে জয়ী হওয়া। কারণ এরাই জনপ্রতিনিধি হয়ে প্রশাসনের বাড়তি সুবিধা নিয়ে অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। আর তাদের নির্বাচনে দু-হাতে টাকা খরচ করছেন অন্য মাদক কারবারিরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সেখানকার মানুষ খুবই শঙ্কিত। কেউ অন্যায় করলে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তার পৃষ্টপোষকতা দেওয়া হলে যা হয় তা-ই হচ্ছে।

জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের কল্যাণ করা হচ্ছে। অযোগ্যরা বড় বড় পদ পাচ্ছে। একটা বিষয় আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, বেড়ায় যদি খেত খায় তাহলে আপনি কোথায় যাবেন? ভবিষ্যৎ কিন্তু খুবই ভয়াবহ। আসলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা খুব জরুরি হয়ে পড়ছে।’

জানা গেছে, আগামীকাল উখিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নে নির্বাচন। এর মধ্যে রাজাপালং ইউনিয়নের প্রার্থীদের মধ্যে ১৫ জন মাদক ব্যবসায়ী, জালিয়াপালংয়ে ৩জন, রত্নাপালংয়ে ৪জন, পালংখালীতে ৩০ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসার অভিযোগ। এদের মধ্যে অনেকেই মাদকসহ গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার এবং নির্বাচনে পুনরায় মেম্বার প্রার্থী আবদুর রহিম। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তের ডেইলপাড়া চাকবৈঠা সীমান্তের শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের একজন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও মেম্বার প্রার্থী হেলাল উদ্দিন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একচ্ছত্র অধিপতি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের  ইয়াবার নিয়ন্ত্রক হিসেবে তার নাম রয়েছে সবার শীর্ষে। একসময়ের শীর্ষ গডফাদার ক্রসফায়ারে নিহত বখতিয়ার মেম্বারের ছেলে হেলাল উদ্দিন। ইয়াবা কারবারে অল্প সময়ে একজন কোটিপতি জনপ্রতিনিধি।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইয়াবা কারবার করে পালংখালী ইউনিয়নের অনেকেই কোটিপতি, বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক। নিজেদের স্বার্থেই তারা রোহিঙ্গা অপরাধীদের পৃষ্টপোষকতা করে যাচ্ছেন। এ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মেম্বার পর্যন্ত ৯০ ভাগই ইয়াবার কারবারি এবং পৃষ্টপোষক বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এমন তথ্য রয়েছে খোদ গোয়েন্দাদের কাছে। জানা গেছে, ইয়াবা কারবারের কাঁচা টাকা দুহাতে ওড়চ্ছেন প্রার্থীরা।

২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী ফজলুল কাদের ভুট্টো পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি সাবেক এমপির একজন বিশ্বস্ত এজেন্ট এবং তার বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের পৃষ্টপোষকতার অভিযোগ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে তার বিশাল এক সিন্ডিকেট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী জাহাঙ্গীর কবির ইয়াবার গডফাদার। তার বিরুদ্ধে মাদক ৯টি, অস্ত্র একটি, মানব পাচার একটি, সব মিলিয়ে ১৮টি মামলা রয়েছে।’

পালংখালী ২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার বখতিয়ার আহামেদ ইয়াবা নিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে পলাতক। তবে তার ভাই জাহাঙ্গীর আলম মেম্বার পদে নির্বাচন করছেন। তিনিও কয়েক দফা মাদক মামলায় জেল খেটেছেন। বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। এসব বিষয়ে সংশ্লিস্টরা মনে করেন মাদক কারবারি ও বিভিন্ন মামলার আসামীরা নির্বাচিত হলে মাদক ব্যবসা সমাজে অশান্তি বৃদ্ধি পাবে, বেড়ে যাবে তাদের দৌড়াত্ব ।

পালংখালী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন। তিনি এক সময়ের পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। আনোয়ারের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মদদদাতার অভিযোগ রয়েছে। তবে তা অস্বীকার করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অবশ্যই ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ ওয়ার্ডে আমরা চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। এর মধ্যে বর্তমান মেম্বার নুরুল আলম মাদক মামলায় জেল খেটেছেন। তার বিরুদ্ধে নাশকতার মামলাও রয়েছে। আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী মফিজুল আলম চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন।’

ইবাংলা/ আমিন / ১০ নভেম্বর ২০২১

Contact Us