মুক্তিযুদ্ধ স্বধীনতা ও বাঙালি জাতির ইতিহাসের ধারক এবং বাহক, বাঙালি জাতির জাগরণ, জাতীয় চেতনার বিকাশ, হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির জন্য গণজোয়ার, অকুতোভয় সংগ্রাম, জয় বাংলা স্লোগান, নৌকা প্রতীকে ভোটদান ও মহান স্বাধীনতা; আর দীর্ঘ যাত্রপথের সোনালি অর্জন এই সবকিছুর মূলেই রয়েছে একটি নাম- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সর্বজনসহ বিশ্বভূখণ্ডে স্বীকৃত, হ্যাঁ! আওয়ামী লীগের হাত ধরেই প্রতিবন্ধকতার পাহাড় ডিঙিয়েছে সংগ্রামময় বাঙালি জাতি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই এই জাতির প্রতিটা পরতে পরতে বীরত্বের খেতাব অর্জিত হয়েছে। ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত কোটি কোটির মানুষকে গনগনে সূর্যের মতো করে জাগিয়ে তুলেছে এই দল। আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, বাঙালির প্রাণ, স্বাধীনতার প্রাণভোমরা। একটি অনুভূতির নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
বাঙালি জাতির প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশজুড়ে গণমানুষের দলে পরিণত হয় এটি। তিনি হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের মধ্যমণি। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথচলা একই সরলরেখায়, তাই কাউকে ছাড়া কারো ইতিহাস রচনা করা সম্ভব না।
আর স্বাধীনতার পর আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়া বাংলাদেশকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছেন মানবতার মা খ্যাত, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও জননেত্রী শেখ হাসিনা। এখানেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। আধুনিক বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা- একই সূত্রে গাঁথা। ৭২ বছর বয়সের পরিণত এই দলটির হাত ধরে আজ বিশ্বের বুকে বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাঙালি জাতি।
আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ : ১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ ভাগ হলো। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের কিছুদিন আগে থেকেই ভবিষ্যত করণীয় প্রসঙ্গে কলকাতায় বৈঠক করতে থাকেন সেখানে অধ্যয়নরত বাঙালি তথা পূর্ববাংলার প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতারা। দেশ ভাগের পরপরই ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন তাদের একটা বড় অংশ। আরেকটা অংশ কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে বৈঠক করে দেশে ফেরেন।
প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ততদিনে ঢাকায় এসে নতুন একটি যুব-সংগঠন করার পেছনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যার ফলশ্রুতিতে ৭ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামের একটি সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন দেশে উগ্র বাম বা উগ্র ডান উভয় পন্থা পরিহার করে, একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা।
কিন্তু শুরুতেই এটি কোন্দলের মধ্যে পড়ায়, ছাত্রদের নিয়ে নতুন ও গতিশীল সংগঠন গড়ার উদ্যোগ নেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার ধারাবাহিকতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। তরুণদের জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে, নিজে যুক্ত হন আওয়ামী লীগে। তারপর নিরলস ছুটতে থাকেন দেশের প্রতিটি জেলার পথে-প্রান্তরে, গণমানুষের কাছে।
দ্রুতই তিনি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে দলের সাধারণ সম্পাদক হন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ অভিমুখে প্রচণ্ড যাত্রাকালে দলের দিকনির্ধারণী ব্যক্তি হিসেবেই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন তিনি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে ইতিহাসের নির্মাতা আওয়ামী লীগকে। নিজের নির্মিত পথে হেঁটেছে রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারক দলটি। দীর্ঘ বাহাত্তর বছরে দলে ভাঙন, শীর্ষ নেতাদের দলত্যাগ, সামরিক জান্তাদের রোষানল, নিষেধাজ্ঞা, হামলা-মামলাসহ কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে আজকের দেদীপ্যমান আওয়ামী লীগ।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ৫ বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের শক্তি-সামর্থ্য প্রমাণিত হয় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়েও কারাগারে যেতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শসিক্ত দলটির ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন।
পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে প্রথম ভাঙন দেখা দেয় আওয়ামী লীগে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বিরোধে ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলর সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি অনুমোদন করেন। মতবিভেদের কারণে আওয়ামী লীগ ছেড়ে নতুন দল গড়েন ভাসানী। পরে নেমে আসে মার্শাল ল’। এ প্রসঙ্গে ‘আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে’ শিরোনামে ২০১৪ সালে এক লেখায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে আবার সকল নেতাকে গ্রেফতার করে।
একাধারে সেনাপ্রধান, আবার রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে মিলিটারি ডিকটেটরের শাসন শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে এটি ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি পদক্ষেপ আর এই দুর্বলতার সুযোগেই সামরিক শাসন আসার সুযোগ পায়।’
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক ও গবেষকরা বলেন, তখন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সরকারে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের কয়েকটি সামরিক চুক্তি হয়। সোহরাওয়ার্দীকে মার্কিন চুক্তির সমর্থক মনে করা হতো। পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি করছিলেন মওলানা ভাসানী ও দলে থাকা বামপন্থিরা; কিন্তু তাতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী।
ওই বিরোধের একপর্যায়ে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে বাতিল হয়। এরপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি হলে ১২ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবকে। তখন লম্বা সময়ের জন্য জেলে যান বঙ্গবন্ধু। ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। দেশে নিষিদ্ধ করা হয় রাজনীতি। গ্রেফতার এড়াতে সিনিয়র নেতারা অবসরের ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ জীবন বেছে নেন।
১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট আইয়ুব দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন। একটি হলো ‘পোডো’ (পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) এবং অন্যটি হলো ‘এবডো’ (ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার)।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ : উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘দুর্নীতির মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতে পারে এই আশঙ্কায় অনেক রাজনীতিবিদ ‘এবডো’ মেনে নিয়ে রাজনীতি থেকে তখনকার মতো অবসরে চলে যান।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন ও মৌলভী তমিজুদ্দিন খান।’ জেল থেকে বের হয়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ মুজিব। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর, একক নেতৃত্বে দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন তিনি।
বর্ষীয়ান নেতারা সামরিক সরকারের আমলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের সাহসী উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব জেলায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মার্চের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে বয়সে জ্যেষ্ঠতার কারণে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করে নিজেই সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকে যান শেখ মুজিবুর রহমান। কয়েক বছরের রাজনৈতিক স্থবিরতা ভেঙে তার হাত ধরে এক নতুন আওয়ামী লীগের পথচলা শুরু হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণঅভ্যুত্থান : এরপর বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি উত্থাপন করলেও দলের কিছু নেতা এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তখন বারবার গ্রেফতার হচ্ছিলেন। ১৯৬৮ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর নামে করা হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ নামের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। জেলে থাকা অবস্থাতেই, ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি নতুন করে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে।
২০২০ সালের ওই লেখায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা লেখেন, ‘শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দাবি পেশ করেন, যা বাংলাদেশের মানুষ ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে গ্রহণ করে। আবারও শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের নেতৃবৃন্দকে বন্দি করা হয়।
একের পর এক মামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে আসে অতীতের মতোই অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম। বন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে ঢাকা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে আরও ৩৪ জন সামরিক-অসামরিক অফিসারসহ সকলকে বন্দি করে রাখা হয়।
শত নির্যাতনের মুখেও আওয়ামী লীগ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ১৯৬৪ সালে দলের পুনঃসংগঠনের সময় কিছু নেতা যেমন বাধা দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি যখন ৬-দফা দেওয়া হলো তখনও কিছু নেতা নেমে পড়লেন দলের ভেতর ভাঙন ধরিয়ে ৮-দফা নামে একটি কোটারি তৈরি করতে।
বলাবাহুল্য, এই ষড়যন্ত্র পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা প্ররোচিত ছিল। তবে এক্ষেত্রে কিছু নেতা দ্রুত নগদ কিছু পাওয়ার লোভে নিজেদের বিকিয়ে দিলেও তৃণমূলের নেতাকর্মী এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতারা সবসময় দলের মূল শক্তি হিসেবে ৬-দফার পক্ষে অবস্থান নেন। আর এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।’
প্রবল জনরোষের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ও স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। এই গণআন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয় এবং ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। অন্যদিকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একচ্ছত্র হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭০-এর নির্বাচন : জিতলেও ক্ষমতায় নেই : এই জাতীয় নির্বাচনে সংরক্ষিত ৭ আসনসহ উভয় পাকিস্তান মিলে ৩১৩ আসনের ১৬৭টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। আবার প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩১০ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত ১০ আসনসহ আওয়ামী লীগের মোট আসন হয় ২৯৮টি।
ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে দীর্ঘ দুই যুগের আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক পথে এগোতে থাকেন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে জনরায় প্রত্যাখ্যানের পাঁয়তারা করতে থাকে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কৌশলে দেশবাসীকে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান : ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ করান বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগদলীয় সদস্যরা ৬-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেন।
কিন্তু ১ মার্চ ইয়াহিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারাবাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
উত্তাল পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চের কাল রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তারা। ফলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এর পরপরই গ্রেফতার করা হয় তাকে।
নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের নির্জন জেলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আপামর বাঙালি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের মুক্তাঙ্গনে শপথ নেন তারা। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও আওয়ামী লীগের ওপর দমন-পীড়ন : স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
একই সঙ্গে চলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন। এ সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয় দল ভাঙাগড়ার খেলা। খন্দকার মোশতাক ‘ডেমোক্র্যাটিক লীগ’ নামে একটি দল গঠন করেও আওয়ামী লীগ ভাঙার চেষ্টা চালায়।
এরপর মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আরেকটা আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচারদের দৌরাত্ম্য ও স্বাধীনতাবিরোধীদের আগ্রাসনে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল অলিখিতভাবে।
নেতৃত্বে শেখ হাসিনা : মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন বারবার : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় শেখ হাসিনা তার স্বামী, দুই সন্তান ও ছোট বোন শেখ রেহানাসহ তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান।
পরের বছর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসনে থেকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারের বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধী দুর্বৃত্তরা এবার তাকেও হত্যাচেষ্টায় মেতে ওঠে।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩৪ বছর বয়সে দলের হাল ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেই থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টানা ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। এই ৯ বছরে বহুবার আটক ও গৃহবন্দি করা হয় তাকে।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে ফ্রিডম পার্টি তাকে হত্যার চেষ্টা করে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন চলাকালে তাকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেলস্টেশনেও তার কামরা লক্ষ করে অবিরাম গুলি ছোড়া হয়।
২০০০ সালে এক জনসভাকে কেন্দ্র করে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের জনসভায় এক ডজনের বেশি গ্রেনেড হামলা চালানো হয় তার ওপর।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপি-জামায়াতের চালানো এই হামলায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন তাকে বাঁচাতে মানবব্যূহ রচনা করা আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী। দলের সভাপতি হওয়ার পর শুধু হামলা-মামলাই নয়; দলের অভ্যন্তরেও আঘাতের মধ্যে পড়েন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের ৭১ বছরের সংগ্রাম ও অর্জন শীর্ষক এক লেখায় স্মৃতিচারণ করে তিনি লেখেন, ‘১৯৮১ আওয়ামী লীগের ওপর আবারও আঘাত আসে। ১৯৮১ সালে আমাকে সভাপতি করে আনা হয়। প্রাণপণে চেষ্টা করি দ্বিখণ্ডিত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। কিন্তু দুগ্রুপের টানাটানিতে পড়ে যাই।
যেহেতু ছাত্ররাজনীতি করেই এসেছি, তাই কোনো গ্রুপে যেতে রাজি হইনি আমি। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। দলের সাধারণ সম্পাদক নতুন দল গঠন করলেন ‘বাকশাল’ নাম দিয়ে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনে ফাটল ধরল।’ ১৯৯১ সালে দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করেন ড. কামাল হোসেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাশাসিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা দিয়ে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিল। ওই বছরের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাকে। মোট ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। ২৪ জুলাই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপে দলের প্রথম সারির অনেক নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, কেউ কেউ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধাচরণ করেন। ২০০৮ সালের ২৩ মে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের ৭২টি সাংগঠনিক শাখার তৃণমূল নেতারা শেখ হাসিনার প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে তার মুক্তিতে দেশজুড়ে চলমান আন্দোলন জোরদার করেন।
আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। জেল থেকে বেরিয়ে গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। তার দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে ভর করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। এরই মধ্যে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দেশজুড়ে অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলের কাজ চলছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছেন। দিয়েছেন শতবর্ষব্যাপী ডেল্টাপ্ল্যান।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন অর রশীদ বলেন, আওয়ামী লীগ এদেশের লাখো-কোটি মানুষের আবেগ-ভালোবাসার নাম। তাই দলটি ৭২ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে জাতির অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে, জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। এই দল অবিনাশী।
বিশ্বের বিস্ময়….
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারিতে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মারা যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে, মহামারি মোকাবিলায় দিনরাত জনসেবায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
ফলে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশের এই ভাইরাসের গণসংক্রমণ ঘটেনি। এমনকি গণমানুষের পাশে সরকার সক্রিয় থাকায় কর্মহীন মানুষদেরও না খেয়ে থাকতে হয়নি। অসহায়দের ঘরে ঘরে খাদ্য ও আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।
এমনকি জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য দলের নির্দেশ মেনে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থাকার কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে দলের অনেক নেতাকর্মীকে। নিজেদের জীবন বাজি রেখে আওয়ামী লীগ সবসময় গণমানুষের পাশে ছিল, এই করোনাকালে তা আবারও প্রাণ দিয়েই প্রমাণ করেছে।
আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের ইতিহাস, দেশ ও মানুষের জন্য নিবেদিত থেকে আত্মদানের ইতিহাস। সুখে-দুঃখে- দুর্যোগে দুর্বিপাকে- সর্বদা গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে- সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়াই আওয়ামী লীগের দৃপ্ত প্রত্যয়।
আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের পথচলার সোনালি অর্জনের নাম বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্র ও জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগের নিরলস লড়াই চলমান রয়েছে। সংগ্রাম ও স্নেহ-ভালোবাসায় একাকার হয়ে, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ- এক অপরের হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়েছে। বাঙালি জাতি জয় বাংলা বলে প্রতিনিয়ত আগে বাড়বে।
লেখক, গবেষক ও বিশ্লেষক: প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় এমপি।
ই বাংলা/ আই/ ২২ জুন, ২০২১