সড়কে গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্য কোনোভাবেই থামাতে পারছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বাড়তি ভাড়া আদায়ে নানা ধরনের কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা। রাস্তায় যা খুশি তাই-এর অনন্য নজির তৈরি করছে রাজধানীর সিএনজিচালিত এই বাসগুলো। চলছে গ্যাসে, তবে ভাড়া কাটছে ডিজেলচালিত বলে।
এমনটি করতে তারা বিভিন্ন ধরনের কৌশলেরও আশ্রয় নিচ্ছেন। এর মধ্যে একটি কৌশল হচ্ছে, স্টিকার পরিবর্তন। বাস চলছে সিএনজিতে কিন্তু সামনে লাগানো হয়েছে ডিজেলচালিত স্টিকার। কেউ কেউ আবার গাড়িতে লাগিয়ে দিয়েছেন ভাড়ার নতুন চার্ট। যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তর্ক লাগলেই দেখানো হচ্ছে এসব স্টিকার ও ভাড়ার চার্ট। এসবের মাধ্যমে সিএনজিচালিত বাসটিকে ডিজেলে চলছে বলে প্রমাণের চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি অনেক বাসে সিএনজির সিলিন্ডার ও গ্যাস ঢুকানোর নোজ্যাল গোপন রাখা হয়।
আরও পড়ুন : জাতির পিতার পরিবারের নিরাপত্তায় এসএসএফ
মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) দিবাগত রাতে সরেজমিন এ ধরনের বেশ কয়েকটি বাসের সন্ধান মিলেছে। এর একটি হচ্ছে সেফটি পরিবহনের বাস। বাসটির এ কৌশল ধরা পড়েছে। এর রয়েছে তেল রিফিল করার ফিলিং পয়েন্টও। তবে পয়েন্টটি খুললেই দেখা যায় এটা আসলে সিএনজি নেওয়ার নোজ্যাল। এমনকি বাসটি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে গ্যাসের মিটারও। শুধু তাই নয়, মূল জায়গা থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার সরিয়ে অন্য জায়গায় বসানো হয়েছে।
একই চিত্র দেখা গেছে, মিরপুরে পার্কিংয়ে রাখা ৯টি গাড়িতে। এ ৯টি গাড়ির মধ্যে ৪টির নিচে দেখা যায় গ্যাস সিলিন্ডার। একটি গাড়ির লোক স্বীকার করেন তারা সিএনজিতে চলাচল করে। মালিকের দাবি, এখনও আগের ভাড়া নিচ্ছে তার সুপারভাইজার। কিন্তু পরদিন ওই বাসটিকে ডিজেলচালিত দাবি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এরকম আরও দেখা যায় তেঁতুলিয়া কোম্পানির কয়েকটি বাসেও। ওইসব বাস সিএনজিতে চললেও ডিজেলচালিত বলে বেশি ভাড়া নেওয়া হয়।
গাবতলী রুটে চলা ৮ নম্বর বাসের যাত্রী মো. মোশাররফ বলেন, ‘৮ নম্বর রুটের বেশিরভাগ বাসে গ্যাসের সিলিন্ডার রয়েছে। যাত্রীরা জিজ্ঞেস করলে বলছে, তেলে চলি। আগে সিএনজিতে চলত। তাই সিলিন্ডার রয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘তেল আর গ্যাসের গাড়ি চেনা যাচ্ছে না আলাদা করে। বেশিরভাগ বাসের কোনটি সিএনজিতে আর কোনটি গ্যাসে চলে তা চেনার উপায় নেই। এভাবে লুকোচুরি করে সিএনজিচালিত বাসেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পেয়েছে বিআরটিএর বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত।’
জানা গেছে, ৮ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৮১টি সিএনজিচালিত বাসের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে ৭০টি বাসের বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবারও বিভিন্ন অপরাধে ৩৪২টি বাস-মিনিবাসকে জরিমানা করা হয়। যার মধ্যে ৬১টি সিএনজিচালিত বাস রয়েছে।
অপরদিকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা শুধু রাজধানীতে ২৪০ থেকে ২৪৫টি বাস চিহ্নিত করেছে যেগুলো সিএনজিতে চলে। এসব বাসের বেশিরভাগই বাড়তি ভাড়াও আদায় করে।
সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলম বলেন, অনেক বাসেই এটা করছে। আমরা সব বাস মালিকদের বলেছি, কোনটি সিএনজিতে চলে আর কোনটি ডিজেলে চলে তা লেখা স্টিকার যেন বাসে লাগিয়ে দেন। আমাদের কর্মকর্তারাও বাসে এ স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরাও মনিটরিং করছেন। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে জরিমানা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়বার করলেই জরিমানার হারও বাড়ছে। সামনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে কারাদণ্ড দেওয়ার চিন্তা আছে।
আরও পড়ুন : বিরোধী দলীয় নেতা পাবেন মন্ত্রীর মর্যাদা
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ৭ নভেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ায় সরকার। তবে সিএনজিচালিত বাসে নতুন এ ভাড়া কার্যকর হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই সময়ে বলা হয়, ঢাকা এক থেকে দুই শতাংশ সিএনজিচালিত বাস রয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা অনেক বেশি। ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ৬ হাজার বাস চলাচল করে। এর মধ্যে ২৪০-২৪৫টি বাস চিহ্নিত করেছেন মালিকেরা। ওইসব বাস সিএনজিচালিত। তারা ডিজেলচালিত বাসের সমান ভাড়াও আদায় করছে। তবে সম্প্রতি কয়েকটি বাসে সিএনজিচালিত স্টিকার লাগানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নির্বাহী সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কিছু গাড়ি প্রতারণা করে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে সত্য। তবে সেই সংখ্যা বেশি নয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি বাস কোম্পানির ২০০ বাস রয়েছে। এর মধ্যে ৫-১০টি বাস সিএনজিচালিত। তাদের কেউ কেউ বেশি ভাড়া নিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসন শক্ত না হলে সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়। মালিকেরাও কঠোর অবস্থানে আছেন। যারা এভাবে প্রতারণা করবে তাদের রুট পারিমট বাতিলের সুপারিশ করা হবে।’
ইবাংলা/এএমখান/১৭ নভেম্বর, ২০২১