মালিক ভাড়া করে বিক্রি করা হয় জালিয়াতিতে যুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির মূল মালিক পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার বোন সোনিয়া মেহজাবিনকে রক্ষা করতেই এই অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। পরিকল্পনামতো সংগ্রহ করা হয় ক্রেতা। এ কাজে ই-অরেঞ্জের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমান উল্লাহর ২০ বছর বয়সী বান্ধবী বিথি আক্তারকে বেছে নেওয়া হয়।
গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ই-অরেঞ্জ শত শত কোটি টাকা লোকসানে পড়লে দায় এড়াতে তারা মালিকানা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করে। চলতি বছরের শুরুতে গ্রাহকদের চোখে ধোঁকা দিয়ে বিথি আক্তারের নামে মালিকানা হস্তান্তরও হয়।
বিষয়টি জানাজানি হলে প্রতারিত গ্রাহকরা আইনের আশ্রয় নেন। সামনে চলে আসে ই-অরেঞ্জের জালিয়াতি ও গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি। সাবেক ও বর্তমান মালিকসহ গা-ঢাকা দেয় চক্রটি। তবে একে একে গ্রেপ্তার হয় প্রতারক সোনিয়া আক্তার, তার স্বামী ও প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা মাসুকুর রহমান, সিওও আমান উল্লাহ ও সাবেক সিওও নাজমুল আলম রাসেল।
দেশ ছেড়ে পালানোর সময় সীমান্তে গ্রেপ্তার হয়ে ভারতে কারাগারে আছেন সোহেল রানা। রিমান্ডে আসামিদের পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে সিওওর বান্ধবীর কাছে মালিকানা হস্তান্তরের চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে ই-অরেঞ্জের জালিয়াতি ও গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে বাজাজ বাংলাদেশসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা রহস্যজনকভাবে হস্তান্তরের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে হস্তান্তর হওয়া ৪০০ কোটি টাকার বিষয়ে জানতে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে সিআইডি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের চিঠি দিয়ে ডাকা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ই-অরেঞ্জের মালিকানা পেতে এক পয়সাও দিতে হয়নি কথিত ক্রেতাকে। উল্টো ক্রেতাকেই দেওয়া হয়েছিল বিপুল অঙ্কের টাকা ও ইউরোপে স্থায়ী বসবাসের প্রলোভন। পরিকল্পনা ছিল ক্রেতা বিথি আক্তারের নামে মালিকানা হস্তান্তর করে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার। সব দায় বিথিকে দিয়ে নিজেদের হাজার কোটি টাকার প্রতারণার অপরাধ আড়াল করা। আর বিথি আক্তারও বিদেশে থাকবে নিরাপদে।
ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনকে বাঁচাতে তার ভাই বনানী থানার বরখাস্তকৃত পরিদর্শক সোহেল রানাকে এই অভিনব বুদ্ধি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির সিওও আমান উল্লাহ চৌধুরী ও কথিত উপদেষ্টা জয়ন্ত দেব নামে এক ব্যক্তি। ‘কনসালটেন্সি’ বাবদ ৩ কোটি টাকা বাগিয়ে নেয় জয়ন্ত। আর আমান উল্লাহকে দেওয়ার কথা ছিল ২৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বিথির নামে হস্তান্তরের পর ই-অরেঞ্জের মূল্য হিসাবে সোনিয়া মেহজাবিনকে ২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেওয়াও প্রতারণার একটি কৌশল ছিল। গ্রেপ্তারকৃতদের গত সপ্তাহে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা প্রতারণার টাকা কীভাবে কোথায় রেখেছে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তারা যেসব তথ্য দিয়েছে, তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারণার উদ্দেশ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ গড়ে তোলা হয়েছিল। বিভিন্ন অফারের নামে তাদের উদ্দেশ্য বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কাক্সিক্ষত অর্থ হাতানোর পর চলতি বছরের শুরুতে প্রতারকরা প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে সব দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার পরিকল্পনা করে। এ জন্য আমান উল্লাহর বান্ধবী বিথি আক্তারকে ‘ভাড়া’ করা হয়। তাকে বলা হয়, মালিকানা গ্রহণ করলে তাকে বিপুল টাকা দেওয়া হবে। পাশাপাশি তাকে ইউরোপে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হবে।
এই দুই ‘অফারে’ রাজি হয়ে যান বিথি। কোম্পানি তার নামে হস্তান্তরের পর মূল্য হিসাবে প্রতারকদের যে টাকা দেওয়া হয়, তা পরিশোধ করা হয় প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকেই। কোম্পানির মালিকানা পাওয়ার পর বিথি আক্তার ১৫ কোটি টাকা ক্যাশ ও ৫ কোটি টাকা সোনিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেন। জয়ন্তকে দেওয়া হয় ৩ কোটি টাকা। আমান উল্লাহকে ২৫ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় তাকে পুরো টাকা দেওয়া হয়নি।
মাসুকুর ও আমান উল্লাহর পরিকল্পনায় গ্রাহকদের টাকা হাতানোর এমন পরিকল্পনা হয় উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলছেন, মাসুকুর একটি বড় কোম্পানির (অ্যান্টি) ফ্রড ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে চাকরি করেছেন। প্রতারণা কীভাবে ঠেকাতে হয় সেটা যেমন তিনি জানেন, তেমনই অভিনব প্রতারণার কৌশলেও তিনি সিদ্ধহস্ত। মাসুকুর ও আমান উল্লাহর বাড়ি একই এলাকায়। আমান আগেও প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিল বনানী থানার বরখাস্তকৃত পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার ক্ষমতার অপব্যবহার। ফলে প্রতারক চক্র হয়ে ওঠে বেপরোয়া।
সোহেল রানাও ই-অরেঞ্জ থেকে বিপুল টাকা হাতিয়েছে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা জানান, বনানী থানার পরিদর্শক হওয়ার সুবাদে সোহেল রানা ই-অরেঞ্জকে প্রশাসনিক সুবিধা দিতেন। বিনিময়ে বোনের প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময় তিনি বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি নগদ টাকাও তিনি নিয়েছেন। এসব টাকা দেশের বাইরে পাচারেরও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তিন প্রতিষ্ঠানের রহস্যজনক লেনদেন : বাইকভ্যালি নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৫০ কোটি টাকা এবং অলজোন নামে আরেক প্রতিষ্ঠানকে ১৮৫ কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে দিয়েছে ই-অরেঞ্জ। বাজাজ কালেকশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিপুল অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা। তিনটি প্রতিষ্ঠানে টাকা হস্তান্তরের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। তবে এ টাকার বিপরীতে ই-অরেঞ্জে প্রতিষ্ঠানগুলো সব পণ্য পরিশোধ করেনি।
তিনটি প্রতিষ্ঠানকে গত ১৮ নভেম্বর চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাবসহ সিআইডি কার্যালয়ে আসতে বলা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, পণ্য না নিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলোয় অগ্রিম বিপুল অঙ্কের টাকা পাঠানো প্রতারণার একটি কৌশল। তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে চক্রটি পরবর্তী সময়ে পণ্য না নিয়ে টাকা নিয়েছে কিংবা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বলে পুলিশের সন্দেহ।
বউয়ের নামে ডাবল ভাউচারে ২০ কোটি টাকা লুটপাট : গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ই-অরেঞ্জের সাবেক সিওও নাজমুল আলম রাসেল বউয়ের নামে ডাবল ভাউচার কিনে ২০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। ডাবল ভাউচার অফার দিয়ে তিনি নিজেই বউয়ের নামে তা কিনতেন। এর পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দ্বিগুণ টাকা বউয়ের অ্যাকাউন্টে পাঠাতেন। এভাবে তিনি প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন।
প্রতারকদের ভুয়া ঠিকানা : ই-অরেঞ্জের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করেছেন। মাসুকুর রহমান ও আমান উল্লাহর গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন হলেও তারা দুজনই ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে সব কাগজপত্র বানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মালিক বিথি আক্তারের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় খোঁজ করে তার ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। প্রতারণার কৌশল হিসেবে তাদের স্থায়ী ঠিকানা লুকিয়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তথ্যসূত্র : আমাদের সময়।
ইবাংলা/জেডআরসি/২২ নভেম্বর, ২০২১