খুতবা না শুনলে জুমা সম্পূর্ণ হয় না

মেহেদী হাসান ফাহিম

শুক্রবার (৩ নভেম্বর) একটার দিকে হানিফ পরিবহনে উঠলাম। আমার কোণাকুণি সামনের সিটে বসেছেন হুজুরটাইপ একজন লোক।তিনি বাস ছাড়ার পরপরই সুপারভাইজারকে বললেন ভাই আমি জুমা পড়বো। নামাজের খুতবার আগে দাঁড়াবেন। সোয়া একটায় দাঁড়ালেই চলবে।

বাস যখন চৌদ্দগ্রাম বাজার পার হচ্ছে তখন সোয়া একটা। তিনি উঠে গিয়ে সুপারভাইজারকে বললেন “ভাই সোয়া একটা বাজে। দাঁড়ান না! খুতবা না শুনলে জুমা সম্পূর্ণ হয় না। আমার তখন চোখে ঘুম ঘুম ভাব। হালকা করে কানে বাজছে ভদ্রলোকের সাথে সুপারভাইজারের বাতচিত। শুধু সুপারভাইজার না আরো কয়েকজন যাত্রী বলছে নামাজ দেড়টায়। একটা পঁচিশে দাঁড়ালেই হবে।

বাসের সে যাত্রীদের মত আমরা অনেকেই জুমার নামাজ পড়াটাকে দায়সারা গোছের বানিয়ে ফেলেছি। শুক্রবার দুপুরে খুতবার শেষ দিকে মসজিদে ঢুকি ও ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর কত দ্রুত মসজিদ থেকে বের হওয়া যায় সে রাস্তা খুঁজি।

আমি চোখ খুলেই বললাম সুপারভাইজার সাহেব, বাস দাঁড় করান। ওযু করার একটা সময়ও লাগবে তো!ভদ্রলোক বললেন আমার ওযু আছে ভাই।অন্যদের অব্যাহত একটা পঁচিশ দাবির মুখে আমার কন্ঠ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। বাস ড্রাইভার একটা পঁচিশে দেখেন রাস্তার পাশে মসজিদ পাচ্ছেন না! আরো মিনিট তিনেক পর ফেনীর ফতেহপুরের দিকে একটা মসজিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ততক্ষণে নামাজ প্রায় শেষ!ভদ্রলোক দৌড়ে গিয়ে নামাজ ধরতে ধরতে ইমাম সাহেব সালাম ফিরিয়েছেন!

বাসে এতগুলো পুরুষ মানুষ। কারো কোন বিকার নেই শুধু ওই ব্যক্তি ছাড়া।আমিও ঐ লোকের সাথে নামলাম, ওনার সাথে নামলাম জুমার নামাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি ছায়া দেখে একজায়গায় দাড়ালাম। ওনাকে দেখলাম কড়া রোদে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছে। জুমা মিস করে ফেলায় সম্ভবত জোহরের নামাজ আদায় করছিলেন।
.
এতক্ষণ বাস একটা পঁচিশে দাঁড়াতে বলা লোকগুলো দ্রুত আশেপাশে চা দোকান খোঁজা শুরু করলো। কেউ কেউ বেনসন সিগারেট না পাওয়ায় বিরক্ত। গ্রামের দোকানে বেনসন না পাওয়া শীর্ষক হতাশা শুনলাম দুজনের গলায়। একজন বিস্কুট কীভাবে পাঁচ টাকা পিস হয় তা নিয়ে দোকানদারের সাথে ঝগড়া করছে।

এক মহিলা বাচ্চার জন্য চিপস কিনতে এসেছেন। শুকনা সুপারি দিয়ে পান খাচ্ছেন দু’জন। আর আমি জানালা দিয়ে ওই আল্লাহর বান্দাকে দেখছি।সুপারভাইজার তখন ইমাম সাহেব কেনো নামাজ তাড়াতাড়ি শুরু করেছেন এটা নিয়ে রাগে গজগজ করছেন!

দশ মিনিট পর বাস ছাড়লো। সুপারভাইজার বারবার লোকটাকে শুনিয়ে বলছিলো : “আইজকা আগে দাঁড়াই গেছে ইমাম সাব।” আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক খুব রেগে যাবেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি একটা কথাও বলেননি। শুধু মাথা নিচু করে নিজের আসনে বসে ছিলেন।আমার কোণাকুণি সামনের সিটে বসেছিলেন বলে আমি তাকে দেখছিলাম।

পুরোটা পথ আর মাথা তোলেননি। সুপারভাইজারও আর কিছু বলেননি। শুধু মসজিদ্দা স্কুল পার হওয়ার সময় বলেছিলেন আমাকে রয়েল সিমেন্ট কোম্পানির সামনে নামাই দিয়েন। ভদ্রলোক উঠে সামনে যাচ্ছিলেন। সুপারভাইজার তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো ভাই কিছু মনে করিয়েন না!

লোকটা আমাকে সর্বোচ্চ অবাক করে দিয়ে সুপারভাইজারের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে দুই চোখে পানি ঝরিয়ে দিয়ে বললো -“ভাই জুমার নামাজটা পড়তে পারলাম না!
একজন বাবা তার দুই দশক ধরে লালিত পালিত একমাত্র কন্যাকে পাত্রস্থ করার সময় “আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো” বলতে যেভাবে কাঁদে একজন মানুষ এক ওয়াক্ত জুমার নামাজ পড়তে না পেরে যেনো তেমন আবেগেই কথাটা বললো!

এই ঘটনাটা পর আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি।ঐ ভদ্রলোক যে জান্নাতের স্বপ্ন দেখেন, আমিও সে একই জান্নাতের স্বপ্ন দেখি। তাহলে আমাদের মধ্যে এত পার্থক্য কেন! কিভাবে সম্ভব যে আমরা দুইজন একই জান্নাতে অবস্থান করব? আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন… আমিন

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা সরকারি আলিয়া মাদরাসা,ঢাকা

ইবাংলা / নাঈম/ ৩ ডিসেম্বর, ২০২১

খুতবা না শুনলেজুমা সম্পূর্ণ হয় নাসুপারভাইজার
Comments (0)
Add Comment