৩ মার্চ বিকেলে ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাপত্র প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়। জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি শুধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নন, তিনি নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদ নেতা, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা। সবাই তাকিয়ে তাঁর মুখের দিকে—তিনি কী বলবেন। তিনি বললেন, তাঁর যা কিছু বলার ৭ মার্চ বলবেন।
৭ মার্চ, রোববার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তবে পয়লা মার্চ থেকেই সব বন্ধ। হরতাল চলছে। সকাল ১০টা থেকেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লোক জমায়েত হচ্ছে। সেদিন যেন মানুষের ঢল নেমেছিল—হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষের স্রোত।
তাদের মুখে একটাই স্লোগান—বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। সত্তরের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যে অভূতপূর্ব ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন, তা তাঁকে করেছিল আরও আত্মবিশ্বাসী এবং একই সঙ্গে দায়িত্বশীল।
পাকিস্তানে তখন মুখ্য চরিত্র তিনটি—আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। তাঁরা তিনজনই জানতেন, পাকিস্তান ভাঙছে। কিন্তু এর দায় নেবে কে?
১ মার্চ ইয়াহিয়ার বেতার ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে মানুষ পথে বেরিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়েছিল। উত্তোলিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলার নতুন পতাকা। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর তৈরি হচ্ছিল প্রচণ্ড চাপ।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এত দিন শেখ মুজিবকে বলে এসেছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’। পাকিস্তান ভাঙার ‘ষড়যন্ত্র’ অভিযোগে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ রুজু করেও কোনো সুবিধা হয়নি। প্রচণ্ড গণ–আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ‘বিচ্ছিন্নতার’ অভিযোগের একটি প্রামাণ্য সূত্রের জন্য।
একদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়ে মাথার ওপর খড়্গ, এর মধ্যে শেখ মুজিবকে অনেক ভাবতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল অংশটি কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে চায়নি। তারা চেয়েছিল স্থিতাবস্থা। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ এল।
৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার ভাষ্যে জানা যায়:
রেসকোর্সে তিনি (শেখ মুজিব) যে ভাষণ দেবেন, আমি সেনানিবাসে বসে তা শুনব। সে ব্যবস্থা করা আছে। তিনি যদি দেশের সংহতি নষ্ট করে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, আমি বিনা দ্বিধায় সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করব।
সেনাবাহিনীকে বলা হবে মিটিং ভেঙে দিতে এবং দরকার হলে ঢাকা শহর গুঁড়িয়ে দিতে। শেখকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়, বিচক্ষণতার পরিচয় না দিলে এর ফল হবে মারাত্মক এবং এর দায় তার ঘাড়েই পড়বে। তাঁর উচিত হবে আলোচনার দরজা খোলা রাখা এবং অনাবশ্যক রক্তপাত এড়ানো।
(খাদিম হোসেন রাজা, আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি)।
৬ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফোন করেছিলেন শেখ মুজিবকে। ইয়াহিয়া অনুরোধ করেছিলেন এমন কিছু না বলতে, যেখান থেকে ফেরার আর উপায় থাকবে না (সূত্র: জি ডব্লিউ চৌধুরী, দ্য লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান)। এর আগে এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ।
৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভাটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। ৬ মার্চ সারা দিন ও রাতে তাঁর দলের হাইকমান্ডের সদস্যদের সঙ্গে বক্তৃতার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন শেখ মুজিব। তিনি এবং তাজউদ্দীন আহমদ মনে করেছিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে অসময়োচিত।
এ প্রসঙ্গে রেহমান সোবহান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের তরুণেরা, যেমন সিরাজুল আলম খান, যিনি কাপালিক নামে পরিচিত, এখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পুরোদস্তুর মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার পক্ষে ছিলেন।
৭ মার্চের সভায় যাওয়ার আগে নুরুল ইসলাম ও আমি তাঁদের মনের ভাব জানার জন্য ইকবাল হলে গেলাম। কাপালিকের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁকে হতাশ মনে হলো। তিনি বললেন, স্বাধীনতার কোনো নাটকীয় ঘোষণা আসছে না’। (সূত্র: রেহমান সোবহান, আনট্রাংকুয়িল রিকালেকশন: দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট)।
৭ মার্চ রেসকোর্সে আয়োজিত স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এসে পৌঁছালেন বিকেল ৩টায়। তিনিই ছিলেন একমাত্র বক্তা। তাঁর গায়ে জ্বর ছিল। তার চেয়ে বেশি উত্তাপ ছিল মাঠে। তিনি জানতেন, মানুষ কী চায়।
জনমনস্তত্ত্ব তাঁর চেয়ে ভালো আর কোনো জননেতা বুঝতেন কি না, সন্দেহ আছে। একই সঙ্গে তিনি টের পাচ্ছিলেন, সামরিক জান্তা আক্রমণের জন্য মুখিয়ে আছে। তাঁর কথার ওপর নির্ভর করছে, মানুষ তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে, নাকি রক্তারক্তি হবে। মাঠে-ময়দানে অনেকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে আছেন।
জনতা তাঁদের পেছনে ছোটেনি। তারা আছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। এখানে তাঁর অনেক দায় এবং একই সঙ্গে দায়িত্ব। বক্তৃতায় তিনি পরিস্থিতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ষড়যন্ত্র এবং নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের কথা উল্লেখ করে ইয়াহিয়ার ডাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য চারটি শর্ত দিলেন। শর্তগুলো হলো:
সামরিক আইন তুলে নিতে হবে;
সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে;
নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের তদন্ত করতে হবে;
এ চারটি শর্ত পূরণ হলেই তিনি অধিবেশনে যোগদানের বিষয়টি ‘বিবেচনা’ করার ঘোষণা দেবেন। তিনি জানতেন প্রথম এবং চতুর্থ শর্তটি মেনে নেওয়া হবে শাসকগোষ্ঠীর জন্য আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় তিনি একটা বার্তা দিলেন যে আলোচনার দরজা তিনি খোলা রেখেছেন।
অন্যদিকে স্বাধীনতাকামীদের তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ বাক্য দুটি তিনি তাঁর ১৯ মিনিটের ভাষণে দুবার উচ্চারণ করেছিলেন। একটা যুদ্ধ যে ধেয়ে আসছে, সেটি বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। তাই একজন গেরিলা নেতার মতোই বললেন, ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারব, আমরা তোমাদের পানিতে মারব।’
শেখ মুজিবের এ ভাষণটি ছিল একেবারেই ‘এক্সটেমপোর’। এত গোছানো বক্তৃতা তিনি আগে কখনো দিয়েছেন কি না সন্দেহ। তাঁর শব্দচয়ন, কণ্ঠস্বরের ওঠানাম, শরীরের ভাষা—সবটাই ছিল অভিনব, অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান–সংবলিত। একই সঙ্গে এটি ছিল শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে দর-কষাকষির শেষ অস্ত্র। শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তির শেষ চেষ্টা। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার এই ভাষণটির নানা রকম ব্যবচ্ছেদ হচ্ছে এবং হতে থাকবে। ভাষণটির বিচার হতে হবে তার সামগ্রিক অর্থে। বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি বাক্য আউরে তাকে বোঝা যাবে না।
৭ মার্চের ভাষণকে এ দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। প্রশ্ন হলো, যিনি এই ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি এর মূল্যায়ন করেছেন কীভাবে? ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভার উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার ইতিহাস কোনো দিন মিথ্যা করতে নাই।
আমার সহকর্মীরা যারা এখানে ছিল, তারা সবাই জানত যে, ২৫ তারিখ রাতে কী ঘটবে। তাদের বলেছিলাম, আমি মরি আর বাঁচি, সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো। বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ৭ মার্চে কি স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল—এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সূত্র : প্রথম আলো।
ইই/ মুক্তিযুদ্ধ/ ২৯ জুন, ২০২১