১১ মুক্তিযোদ্ধা ও ২ শহীদ পরিবারের স্মৃতিচারণ

ইবাংলা ডেস্ক

মানিকগঞ্জ শহরের কোল ঘেঁষেই সবুজ-শ্যামল ও নিরিবিলি একটি গ্রাম সদর থানার সেওতা। সাদা চোখে অন্য সব গ্রামের মতো মনে হলেও সেওতার আছে আলাদা বিশেষত্ব। জনপদটিকে এই বিশেষত্ব দিয়েছে একটি পরিবার। সেওতা গ্রামের ওই পরিবারের ১১ জন সদস্য দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন দুজন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পরিবারটির ব্যবসা ও সম্পত্তির বড় অংশ ধ্বংস করে ফেলেছিল পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। আজও সারা গ্রামের মানুষ তাঁদের জন্য গর্ববোধ করে।

বিজয়ের মাসে এই পরিবারের বীরত্বগাথা জানতে গত ২৪ ডিসেম্বর এই প্রতিবেদক ছুটে যান সেওতায়। দেখা যায়, গ্রামটি ঘিরে রাখা দুটি সড়ক পরিবারটির দুই শহীদের নামে। একটি ৭ নম্বর শহীদ তজু সড়ক, আরেকটি শহীদ টিটো সড়ক। তবে যাঁদের নামে সড়ক দুটি, সেই দুই বীর যোদ্ধার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তার অবস্থাই খারাপ। গ্রামের অনেকে বললেন, এই সড়কের মতোই অবহেলিত থেকে গেছে শহীদদের পরিবারের সদস্যরাও। পরিবারটির চার মুক্তিযোদ্ধা সদস্যের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাকিরা থেকে গেছেন আড়ালেই।

গ্রামের বর্ষীয়ান মানুষ ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৭১ সালে তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমার ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন দুই ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মধু মিঞা ও গোলাম মর্তুজা ওরফে কানাই মিয়া। প্রথমে যুদ্ধে যান তাঁদের ছোট ভাই গোলাম আহমেদ ওরফে ফেলা মিঞা (৩২) ও গোলাম মর্তুজার ছেলে গোলাম কিবরীয়া ওরফে তজু। যুদ্ধে যাওয়ার কিছুদিন পরই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন তজু।

নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এই ঘটনা তজুর চাচাতো ভাই ও গোলাম মোস্তফার কিশোর ছেলে গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীর টিটোর মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ‘যে দেশের জন্য আমার ভাই মরেছে, সে দেশের স্বাধীনতা দেখতে চাই আমি,’ এমন পণ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিশোর টিটো। কিন্তু বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে সাভারের জিরাবোতে এক যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হয় সে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর স্পষ্ট মনে আছে শহীদ টিটোর কথা। এ প্রতিবেদককে তিনি বললেন, ‘বয়স কম থাকায় টিটোকে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাকে আমাদের ক্যাম্পে থাকা চার শর বেশি মুক্তিযোদ্ধার খাওয়াদাওয়ার বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।’

নাসির উদ্দীন ইউসুফ জানালেন, ১৪ ডিসেম্বর সাভারে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলের সঙ্গে যুদ্ধ হয় তাঁদের। ছোট বলে সঙ্গে নেওয়া হয়নি টিটোকে। কিন্তু সে লুকিয়ে পিছু নেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে জরুরি নির্দেশনা পৌঁছে দিতে দৌড়ে যাওয়ার সময় মেশিনগানের গুলিতে মৃত্যু হয় তার।

শহীদ তজু ও টিটোর পরিবারকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম খান কামাল। দেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সাটুরিয়া-মানিকগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য তিনি। স্মৃতিচারণা করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতার জন্য এই পরিবারের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাদের পারিবারিক ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা। এ পরিবারের কিশোর-বৃদ্ধ-নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন।’

শহীদ টিটো ছাড়াও তার আপন ভাই গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর, গোলাম মোহাম্মদ শাহ্গীর, গোলাম মোহাম্মদ বন্দেগীর লিটো, গোলাম মোহাম্মদ ছগীর কিটো ও গোলাম মোহাম্মদ রাহ্গীর বিল্টো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া তজুর আপন ভাই ও টিটোর চাচাতো ভাই গোলাম মোস্তাকিম ওরফে হিটোও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা ছিল গোলাম মোস্তাকিমের, যিনি পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েছিলেন। তজুর আরেক ভাই গোলাম শামীম লাভলু ও বোন শামসুন্নাহার ছায়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেন।

মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পরিবারের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শহীদ তজুর মাকে ধানমণ্ডিতে জায়গাসহ বাড়ি দিয়েছিলেন। এছাড়া শহীদ তজুর নামে সড়ক হয়েছে, তাঁদের এক ভাই সরকারি চাকরি পেয়েছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারটির অবদান অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। এই পরিবারের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেঁচে আছেন শুধু গোলাম মোহাম্মদ রাহ্গীর ও গোলাম সারোয়ার লাভলু।

শহীদ তজুর ছোট ভাই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সারোয়ার লাভলু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১২-১৩ বছর ছিল। তজু ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আসত। আমি তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতাম। কিছু করতে বললে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমিও যুদ্ধে যাওয়ার বায়না ধরতাম। কিন্তু ছোট বলে তারা আমাকে সঙ্গে নিত না।’

এলাকার মানুষ বলছে, শহীদ তজু ও টিটোর স্মৃতি জাগিয়ে রাখা দুটি সড়ক ঘিরে রেখেছে সেওতা গ্রামটিকে। জরাজীর্ণ সড়ক দুটির দ্রুত সংস্কার চায় তারা। আর চায় তালিকায় না থাকা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি।সূত্র: কালের কণ্ঠ

ইবাংলা / নাঈম/ ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১

মুক্তিযোদ্ধাস্বাধীনতাস্বীকৃতিস্মৃতিচারণ
Comments (0)
Add Comment