দেশে অর্থনীতি এখনো স্বাভাবিক ধারায় ফেরেনি। তাই চলতি বছরের পুরোটা সময় অর্থনীতি মিশ্র প্রভাবে পার করেছে।অর্থনীতিতে মানুষের অস্বস্তির প্রধান কারণ ছিল ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি’। তবে নতুন অর্থবছর থেকে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ আবারও শঙ্কা তৈরি করেছে।
সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশপাশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে। আমাদের রপ্তানি ভালো করছে। তবে ওমিক্রন শঙ্কায় এটা কত দিন ভালো থাকবে, তা ভাবার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স খাতের অবস্থা মাঝে খারাপ ছিল, এখন মোটামুটি ভালো। আমদানি বেড়েছে। আশা করা যায়, তাতে বিনিয়োগ বাড়বে। বেসরকারি খাতের ঋণ ৮ শতাংশ ছিল, এখন তা ৯ শতাংশ। এটিও মোটামুটি ভালো। তবে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য চ্যালেঞ্জ।’
যেকোনো বছরকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। গত অর্থবছরের শেষ দিকের অর্থনীতির অবস্থা এবং নতুন অর্থবছরের ছয় মাসের অবস্থা। যদিও নতুন অর্থবছরের পাঁচ মাসের তথ্য পাওয়া যায়, সেটি দিয়েই মূল্যায়ন করতে হয়।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাস শুধুই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আর লকডাউনের গল্প। আর শেষ ছয় মাস অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার গল্প। সেই সঙ্গে আছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, জনজীবনে ব্যয়বৃদ্ধি এবং ভোগান্তির কথা।
চলতি বছরের শুরুতে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা লাগে অর্থনীতিতে। ডিসেম্বরে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হলেও এর চূড়ান্ত রূপ পায় চলতি বছরের এপ্রিলে এসে। সরকার বাধ্য হয়েই লকডাউন দেয়। এতে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, পরিবহনব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসে।
পুঁজিবাজার পরিস্থিতিও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পরে লকডাউন উঠে গেলেও অর্থনীতি ধুঁকতে থাকে। বিভিন্ন সূচক নেতিবাচক অবস্থায় ছিল। এ অবস্থা চলতে থাকে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত। সরকার বাধ্য হয়েই কৃচ্ছ সাধনের মতো কঠোর নীতি অবলম্বন করে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করে। এতে অপ্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
অর্থনীতি ধুঁকতে থাকায় গত অর্থবছরে সরকার বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন ৮.২ শতাংশ নির্ধারণ করলেও করোনার কারণে তা কমিয়ে ৬.১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু প্রকৃত জিডিপি অর্জিত হয় ৫.৪৭ শতাংশ। তবে অর্থবছর শেষে ভালো সংবাদ আসে মাথাপিছু গড় আয়ে। গত অর্থবছরের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৪৫ ডলারে উন্নীত হয়, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ২২৭ ডলার।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সূচকগুলো আবার ইতিবাচক ধারায় চলে আসতে থাকে। গত অক্টোবরে আমদানি সর্বোচ্চ রেকর্ড অতিক্রম করে। ২০২১ সালের অক্টোবরে ৭১১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা একক মাসের হিসাবে সর্বকালের সর্বোচ্চ।
এটি গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ২৭৪ কোটি ডলার বেশি। আর জুলাই-অক্টোবরে পণ্য আমদানি হয়েছে দুই হাজার ৫৮৩ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময় ছিল এক হাজার ৭০৬ কোটি ডলার। আমদানির মতো রপ্তানিও স্বধারায় ফিরে আসে। জুলাই-নভেম্বর—এ পাঁচ মাসে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৯৮৯ কোটি ডলারের পণ্য। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪.২৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি ছিল এক হাজার ৫৯২ কোটি ডলার।
ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার গতি বেড়ে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়ে স্বস্তি আসে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে এক লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হলেও রাজস্ব আদায়ে গতবারের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
গত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আবারও গতি পায়। এসব কাজে ব্যয় বাড়ে। এ কারণে গত পাঁচ মাসে সরকারের ব্যাংকঋণ বেড়ে হয় ১৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা।
ইবাংলা /টিআর/৩১ ডিসেম্বর