বাংলাদেশে একজন উদ্যোক্তা শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে গেলে নানা কোম্পানির ছাড়পত্র নিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্সের জন্য সিটি করপোরেশনে গেলে নাম নিবন্ধনের জন্য যেতে হয় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অব ফার্মস অফিসে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ছাড়পত্র পেলে টালবাহানা শুরু হয় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়ে। এরপর রয়েছে বিএসটিআই, স্বাস্থ্য অধিদফতর, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।
এমনকি কোনো কোনো ব্যবসায় বিস্ফোরক অধিদফতর ও তথ্য অধিদফতরের ছাড়পত্রও লাগে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে। এতসব দফতর আর অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে এসে অনেকের মাসের পর মাস চলে যায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত এসব সংস্থা ও দফতরের নিয়ন্ত্রণ এবার কমাতে চাইছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে কোনো একটি ব্যবসা শুরু করতে প্রায় ৩৩টি সংস্থার অনুমোদন লাগে। এটি কমানোর সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক গঠিত একটি সাব-কমিটি। ওই কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছে, বিশ্বের কোনো দেশেই এত বেশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিমাণ কমিয়ে আনা জরুরি।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি, পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং সংক্রান্ত সাব-কমিটির বৈঠকে এটিসহ কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে। উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের নেতৃতে গঠিত জাতীয় কমিটিকে সহায়তা করার জন্য বিষয়ভিত্তিক সাতটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ বাজার উন্নয়ন ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ বিষয়ক উপকমিটির বৈঠকটি হয় ৫ ডিসেম্বর।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বলা হয়, কোনো একটি ব্যবসা শুরু করতে প্রায় ৩৩টি সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, যা ন্যূনতম সংখ্যায় হ্রাস করা জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, তারা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর সময় কম ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প বা কল-কারখানায় বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র প্রদান হতে অব্যাহতির সুপারিশ করেছিলেন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, নিবন্ধন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ট্যাক্স নিবন্ধন গ্রহণসহ যেসব ইস্যু সেবাদানের বিষয়ে অনলাইনে পাওয়া যায় সেসব বিষয়েও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দিয়ে আসছেন। এর ফলে কিছু কিছু সংস্থা অনলাইনে সার্টিফিকেট দিচ্ছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ করতে তারা যেসব সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ইজি অব ডুয়িং বিজনেস সূচক প্রকাশ বন্ধ হলেও বিডার সংস্কার কার্যক্রম চলবে। এ বিষয়ে তারা নতুন একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছেন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাব-কমিটির সভায় আরও যেসব সুপারিশ উঠে আসে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : প্রক্রিয়াধীন শিল্পনীতিতে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল লজিস্টিক বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা; নতুন উদ্যোক্তা এবং নির্দ্দিষ্ট পণ্য উৎপাদনকারীদের নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে ঝুঁকি ভাগাভাগিতে সরকারের এগিয়ে আসা; উচ্চমানের উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরিতে নীতি সহায়তা বাড়ানো; আন্তর্জাতিক ব্যাংক গ্যারান্টির অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে (আইএসপি ৯৮) স্বাক্ষর করা; মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি উৎসাহিত করতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া; বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের হিসাব বের করা; বাণিজ্যে অর্থায়নকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া; খরচ কমাতে ডলারের পাশাপাশি বিকল্প লেনদেনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
পরিবেশ সহায়ক বাণিজ্য (গ্রিন ট্রেড ফিন্যান্স) বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে এখনই গ্রিন ব্যাংকিং সেগমেন্ট খোলার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা; রপ্তানি-আমদানি পণ্য ও সেবার কোয়ালিটি সার্টিফিকেশন প্রাপ্তি ও বাংলাদেশি নিজস্ব পণ্য ও সেবার গ্লোবাল রেজিস্ট্রেশন (আইপিআর)-এর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া; বাণিজ্য সংক্রান্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনা মনিটরিংয়ের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা; ব্যবসায় কস্ট অব ফান্ড কমাতে ঋণখেলাপি সমস্যা জরুরিভিত্তিতে সমাধান করা এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য একক নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ও পরিমাণ অনেক বেশি। এর ফলে মূলধন পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সে কারণে ঋণখেলাপির বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির আওতায় সমাধান করা উচিত। এ সমস্যাকে কীভাবে দ্রুত নিষ্পত্তির আওতায় আনা যায় তা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বসে ঠিক করতে পারে।
এছাড়া বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য বিডা সার্বিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। দুটি সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থায়নে সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। এটিকে একক নিয়ন্ত্রণে আনার সুপারিশও এসেছে সভায়। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন