পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ উপকূলের পতিত জমি, বালুর ধুম, ধুধু বালুরচরসহ আবাদি জমিতে দিনদিন বিস্তৃত হচ্ছে রসালো ফল তরমুজের চাষ। স্বল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় আগাম তরমুজ চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। অনুকূল আবহাওয়ায় আগাম চাষে মিলেছে বাম্পার ফলনও। উচ্চ বাজার মূল্য পাচ্ছেন তারা। বাম্পার ফলন ও ভালো দামে খুশি চাষীরা।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বীজ বপন ও উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয় মূলত ফেব্রুয়ারি মাসে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আবহাওয়া তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। বীজ বপনের জন্য ফেব্রুয়ারি মাস সর্বোত্তম। আগাম ফলন পেতে হলে জানুয়ারি মাসে বীজ বুনে শীতের হাত থেকে কচি চারা রক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়।
এ অঞ্চলের কিছু সংখ্যক কৃষক নভেম্বরে বীজ বপন করেন। তবে নভেম্বরে যে সকল জমিতে তরমুজ চাষ করেন তা পতিত বালুর ধুম, বালুরচর। এ জমিতে অন্য কোন ফসল দেয় না কৃষকরা। তরমুজ চাষের উপযুক্ত মৌসুম ফেব্রুয়ারি মাসে মূলত ফসলি জমিতে চাষ করা হয়।
আগাম তরমুজ চাষে কঠোর পরিশ্রম হলেও ভালো ফলন, উচ্চ বাজার চাহিদা, বেশ লাভজনক হওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় দিনদিন বাড়ছে রসালো মৌসুমী ফল তরমুজের চাষ। চলতি মৌসুমে আগাম চাষে মিলেছে বাম্পার ফলন।
মৌসুমের তিন মাস আগে বাজারে আসায় চাষীরাও পেয়েছেন উচ্চ মূল্য। কিন্তু মিস্টি পানির সংরক্ষণ বাড়ানো গেলে এক মৌসুমে এখাত থেকেই আয় হতে পারে হাজার কোটি টাকা, এমনটাই জানিয়েছেন তরমুজ চাষীরা।
কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্বদিকে সুর্যোদয় পয়েন্টের বালুরচরে ১৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করছেন আল-আমিন। সরেজমিনে আল-আমিনের ক্ষেতে গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষেতের পাশে পাকা তরমুজ কেটে দুইটি স্তুপ করে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সৈকতে একটি ট্রলী গাড়ি গিয়ে থামছে তরমুজের স্তুপের পাশে। ব্যবসায়ীরা তরমুজ ট্রলী গাড়িতে তুলছেন। তাদের প্রত্যেকের চোখে মুখে রয়েছে আনন্দের ছাপ।
কৃষক আল-আমিন জানালেন, তিনি একাই ৪ ধাপে ১৬ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। প্রথম ধাপে লাগানো ক্ষেত থেকে বড়-মাঝারি সাইজের ১ হাজার তরমুজ ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রয় করেছেন। এই ক্ষেতে পুনরায় সার-কিটনাশক প্রয়োগ ও পানি সেচ করে পরিচর্যা করবেন। পুরানো লতায় আবার নতুনের মতো ফল আসবে। কারণ এখনই তরমুজ চাষের উপযুক্ত সময়।
দ্বিতীয় ধাপে লাগানো ক্ষেতের তরমুজ চলতি মাসের শেষের দিকে বিক্রয় করতে পারবেন। তৃতীয় ধাপে ক্ষেতে ফুলে-ফলে ছেয়ে গেছে লতা। শেষ ধাপের ক্ষেতে এখনও ফুল আসে নি। লতায় ছেয়ে গেছে পুরো ক্ষেত। চাষী আল-আমিন বলেন, ১৬ বিঘা জমিতে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার টাকা বিক্রয় করছি। আরও দুই লক্ষ টাকা বিক্রয় করার আশা আছে।
আল-আমিনের ক্ষেতের উত্তর পাশে ১০ একর জমিতে তরমুজ চাষ করছেন আবদুর রহমান। তিনি ক্ষেতের লতায় বালাইনাশক প্রয়োগ করছেন। কথা হয় তার সাথে-তিনি জানান, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বীজ বপন করেছেন। আগামী এপ্রিলে তার ক্ষেতের তরমুজ বিক্রয় করতে পারবেন। তার ক্ষেতের লতার ডগায় ফুল-ফল এসেছে। ক্ষেতের অবস্থা খুবই ভালো।
তিনি বলেন, আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে আছে, শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে দ্বিগুন লাভ হবে। যখন আমার ক্ষেতের তরমুজ বিক্রয়ের উপযোগি হবে তখন ভালো দাম থাকলে লাভ বেশি হবে।
আল-আমিনের ক্ষেত থেকে এক হাজার তরমুজ কিনছেন ব্যবসায়ী মো. রফিক হাওলাদার। কথা হয় তার সাথে-তিনি বলেন, আগাম তরমুজে বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। ভালো দাম পাবার আশায় ঢাকা নিয়ে যাচ্ছি।
কাউয়ারচর এলাকায় আগাম তরমুজের চাষ বেশি হয়। ওই এলাকার জমি আগাম তরমুজ চাষের জন্য বেশ উপযোগি। বেড়িবাঁধের বাহিরে পাশাপাশি ক্ষেতে তরমুজ চাষ করেছেন মোঃ রায়হান, আঃ সোবাহান ও আঃ কুদ্দুস। তারা প্রত্যেকে ক্ষেত থেকে তরমুজ বিক্রয় করেছেন। তাদের ক্ষেতে এখনও বেশ কিছু ছোট কাচা তরমুজ এবং লতার ডগায় ফুল আছে। তারা ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন।
কৃষক আঃ সোবাহান বলেন, আগাম তরমুজ দিয়েছি। ফলও বেশ ভালো পেয়েছি। কিন্তু পানির সমস্যা আছে। বহু দূর থেকে পানি আনা কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। সরকারিভাবে পানির সুব্যবস্থা করলে আমাদের কৃষকদের জন্য ভালো হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয় লতাচাপলী ও ধুলসার ইউনিয়নে। এছাড়া ডালবুগঞ্জ, নীলগঞ্জ, মহিপুর, মিঠাগঞ্জেও তরমুজের চাষ হয়। উপজেলায় ব্লাক বেঙ্গল, ড্রাগন ও গ্লোরি প্রজাতির তরমুজ চাষ করা হয়েছে। চাষিরা জানান, প্রতি বছর তাদের ক্ষেতের তরমুজ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকে কিনে নেন।
এবারও কিনছেন, কিনবেন। ধাপে ধাপে তৈরি করা তরমুজ ক্ষেতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। তারা ধান চাষের অনুপযোগী জমি, নদীর জেগে ওঠা চর কিংবা জমি বর্গা নিয়ে তিন প্রজাতির তরমুজ চাষ করেছেন। কোনো সরকারি প্রণোদনা ছাড়াই তারা দেশীয় পদ্ধতিতেই তরমুজ চাষ করছেন। কৃষি বিভাগের আর্থিক সহযোগিতা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করলে আরও লাভবান হওয়া যেত বলে মনে করেন কৃষকরা।
চাষী বায়হান বলেন, আমার ক্ষেত থেকে ৩ লক্ষ টাকা বিক্রয় করছি। এখন ক্ষেতে যে তরমুজ আছে তা এক ব্যবসায়ী ৩ লক্ষ প াশ হাজার টাকা দাম বলছেন। আরো কয়েকদিন পর বিক্রয় করলে দাম বেশি হবে। কৃষক আঃ কুদ্দুস বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গাছ ও ফল ভালো হয়েছে। আমরা খুশি হয়েছি।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ.এম.আর.সাইফুল্লাহ জানিয়েছেন, পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে উন্নত জাতের তরমুজ আগাম চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি অতিমাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ যাতে না করে সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে তদারকি করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আধুনিক চাষেও উদ্বুদ্ধ করি। কোন সার, কোন মাটি তরমুজের জন্য উপযোগি সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চলতি মৌসুমে উপজেলায় আগাম ২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।
ইবাংলা/ জেএন/ ১০ মার্চ, ২০২২