ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাশওয়ারা বা পরামর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। পরামর্শের মাধ্যমে ঐক্য ও পারস্পরিক ভালোবাসা সুদৃঢ় হয়।পরামর্শ করে কাজ করলে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। সম্মিলিত চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণের কারণে সহজ ও উত্তম সমাধান বেরিয়ে আসে।
পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা : ইরশাদ হয়েছে- ‘যারা তাদের রবের নির্দেশ মেনে চলে, নামাজ কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়, আমি তাদের যা রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত-৩৮) যে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শরিয়ত কোনো বিশেষ বিধান নির্দিষ্ট করেনি, প্রত্যেক মুসলমান সেগুলো মীমাংসার কাজে তারা যেন পরস্পর পরামর্শ করে। ইমাম জাসসাস (রহ.) বলেন, এ আয়াত থেকে পরামর্শের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এতে আমাদের প্রতি পরামর্শসাপেক্ষ কাজে তাড়াহুড়া না করার, নিজস্ব মতকেই প্রাধান্য দিয়ে কাজ না করার এবং জ্ঞানী ও সুধীবর্গের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে প্রদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে।
পরামর্শের গুরুত্ব ও পন্থা : একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো। যদি আমরা এমন কোনো বিষয়ে কোরআন এবং হাদিসের ফয়সালা না পাই সে ক্ষেত্রে কি করব? জওয়াবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এর জন্যে আমার উম্মতের ইবাদতকারীদেরকে একত্রিত করবে এবং পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কর্তব্য স্থির করবে। কারো একক মতে ফয়সালা করো না।
কর্মীদের সাথে পরামর্শ করা অপরিহার্য : ইরশাদ হয়েছে- ‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হূদয়সম্পন্ন হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরার্মশ করো। অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-১৫৯) কোনো কর্মীকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এটা একজন বিজ্ঞ নেতার কাজ নয়; বরং সবাইকে নিয়ে কাজ করা একজন অভিজ্ঞ নেতার কাজ। পরামর্শের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দ্বারা এতে সকলেই দোয়া করে, থাকে মহান রবের অশেষ রহমত।
বদর যুদ্ধ পরামর্শ : সকলেই জানেন ২য় হিজরীর ১৭ রমযান মোতাবেক ১১ মার্চ, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবারের সংগ্রামের কথা। সকলের কাছে যা বদর যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ, এটি ছিল মুসলমানদের জন্যে নবজাগরণের মাইলফলক। সেদিনটি ছিল এক হাজার কাফির সৈন্যের বিরুদ্ধে ৩১৩ জনের লড়াই, মুসলমারা যুদ্ধের প্রস্তুতি না নিলেও কাফিররা ঠিকই প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়ে পড়ছেন। বিরাজ করছে কঠিন পরিস্থিতি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রস্তুতি ও বদরের নিকটবর্তী (সাফরা) নামক স্থানে পৌঁছার সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ মুহাজির ও আনসারদের নিয়ে জরুরি পরমর্শে বসলেন যে, আমরা এদের সাথে যুদ্ধ করব কি করব না? আবু আইয়ুব আনসারীসহ কতিপয় সাহাবি বললেন, এ পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে তাদের মোকাবিলা করার সামর্থ্য নেই। তাছাড়া আমরা তো এ উদ্দেশে আসেনি।
এরপর আবু বকর (রা.) দাঁড়িয়ে নবীজির ইশারাকে আকুণ্ঠ গ্রহণ করলেন এবং মনে-প্রাণে তার নির্দেশ পালনে নিজেকে উৎসর্গ করার ঘোষণা দিলেন। উমর (রা.) দাঁড়িয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তার সমর্থন ব্যক্ত করলেন এবং জীবনবাজি রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করলেন। অতপর মেকদাদ বিন আসওয়াদ (রা.) খুবই দৃঢ়তার সাথে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আল্লাহতায়ালা আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন আপনি তা বাস্তবায়নের উদ্যোগী হউন। আমরা আমৃত্যু আপনার সাথে আছি। আল্লাহতায়ালার কসম করে বলছি, আমরা আপনাকে বনী ইসরাইল কর্তৃক হজরত মুসা (আ.)কে প্রদত্ত জবাবের মতো জবাব দেব না। (আপনি ও আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন আমরা এখানেই বসলাম)
সে সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন। আপনি যদি আমাদেরকে সুদৃঢ় হাবশার (বারকুল গামাদেও) নিয়ে যান আমরা যুদ্ধের জন্য অবশ্যই আপনার সাথে যাব।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেকদাদ (রা.)-এর সুদৃঢ় বক্তব্য শুনে আনন্দিত হয়ে উঠলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন। কিন্তু তখনো আনসারদের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য শুনেননি। তাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনে করলেন তাদের সাহায্য শুধু মদিনার ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল। মদিনার বাইরে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল না। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকলের উদ্দেশে বললেন, (হে লোক সকল তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও) আনসার নেতা সাদ বিন মুআয (রা.) কথার বাচনভঙ্গি বুঝতে পারলেন যে, নবীজির সম্বোধন আনসারদের প্রতি। সাথে সাথে তিনি দাঁড়িয়ে বললেন- ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং একথার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি যা বলেন সবই হক ও সত্য। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার আনুগত্য করার জন্য ওয়াদাবদ্ধ।
সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনি যে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তা সম্পাদন করুন। সে সত্তার কসম! যদি আপনি আমাদেরকে গভীর সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমরা কথা দিচ্ছি, আমরা এখনই সমুদ্রে মধ্যে লাফিয়ে পড়তে দ্বিধা করব না। আমাদের একজন লোকও পিছপা হবে না। আমাদের বিশ্বাস আল্লাহতায়ালা আমাদের মাধ্যমে এমন জিনিস প্রত্যক্ষ করাবেন যা দেখে আপনার নয়ন জুড়িয়ে যাবে। আমাদের আপনি আল্লাহর নামে যেখানে খুশি নিয়ে চলুন। সাদ বিন মুয়াযের বক্তব্য শুনে যারপরনাই খুশি হলেন। রাসুল (সা.) যোদ্ধাদেরকে আল্লাহর নামে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সুসংবাদ শুনালেন যে, আমাকে আল্লাহতায়ালা আবু জেহেল কিংবা আবু সুফিয়ান দুদলের যে কোনো একটির ওপর বিজয় দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাদের ধরাশায়ী হবার নির্দিষ্ট স্থানগুলো পর্যন্ত দেখিয়েছেন যে অমুক এখানে নিহত হবে আর অমুক ওখানে। এদিকে মুসলমানদের কাছে খবর আসলো- কুরয বিন জাবের মুহারবী ও কাফেরদের সাহায্য করার সংকল্প করেছে এবং সৈন্য বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে। এ সংবাদ শুনে মুসলিম শিবির আল্লাহতায়ালার দরবারে সাহায্যের ফরিয়াদ জানাল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন তোমরা স্বীয় প্রতিপালক সমীপে ফরিয়াদ করছিলে (নিজেদের স্বল্পতা ও প্রতিপক্ষের আধিক্য দেখে) অতঃপর তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন (এবং বলেছেন) আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করব যারা একের পর এক পৌঁছতে থাকবে।’ (সুরা আনফাল)
অতঃপর কুরয বিন জাবেরের সাহায্যের খবর জানাজানি হয়ে গেলে আল্লাহতায়ালা অতিরিক্ত দুটি প্রতিশ্রুতি দিলেন। যেমন সুরা আলে ইমরানে তিন হাজার ও পাঁচ হাজার ফেরেশতার আগমনের তথ্য দিয়ে বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বুঝা গেল রাসুলুল্লাহ (সা.) সব কিছু জানতেন আল্লাহতায়ার সাহায্যের কথা কিন্তু তার পরেও সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করলেন। তার কারণ হলো, কর্মীদের যোগ্যতা ও ঈমানের দৃঢ়তা কতটুকু রয়েছে।
উহুদ যুদ্ধে পরামর্শ : রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের কথা আজো নাড়া দেয় মুসলমানদের হূদয়কে। ৩য় হিজরির শাওয়াল মাসে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। যা মদিনা মুনওয়ারাহ হতে এক ফারসাখ ১৮ হাজার ফুট, তিন মাইলেরও বেশি দূরত্ব দূরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়ের নাম উহুদ। এটি ছিল ইসলামের সোনালী যুগে মুনাফিক এবং মুমিনের পার্থক্যের দিন। সেদিন ছিল ৩ হাজার কাফির সৈন্যের বিরুদ্ধে ১ হাজার মুসলমান সৈন্যের লড়াই। কাফির সৈন্যদের সকল খবর যখন মদিনায় পৌঁছে তখন রাসুল (সা.) সাহাবিদের সাথে এখন কী করণীয়তা নির্ধারণের পরামর্শ চান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের মতামত ছিল মুসলমানরা মদিনার বাইরে যাবে না। কাফিররা যদি মদিনায় প্রবেশ করে আক্রমণ করে তখন মদিনাতেই তাদের মুখোমুখী প্রতিরোধ করা হবে। আর মদিনার নারীরা ওপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে কাফেরদের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলবে এবং ছন্নছাড়া করে দিবে। অনেক সাহাবির মত এধরনেরই ছিল। আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর মতও অনুরূপ ছিল। কিন্তু বড় বড় সাহাবিদের একদল, বিশেষ করে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পেরে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় অধীর আগ্রহী, তারা বলতে লাগলো, আমরা মদিনার বাইরে যুদ্ধ করব। মদিনার ভেতরে বসে থাকা কাপরুষেরই নিদর্শন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি স্বপ্ন দেখি যে, একটি মজবুত প্রাচীরের ভেতর একটি গরুকে জবাই করা হচ্ছে। এর ব্যাখ্যা হলো আমার সাথীদের মধ্যে কিছু লোক শাহাদাৎবরণ করবে। একারণে আমার মত হলো মদিনায় দূর্গ স্থাপন করে তাদের প্রতিরোধ করা হবে। কিন্তু যুবকরা ছাড়াও বড় বড় অবিজ্ঞ সাহাবি যেমন-হামযা (রা.) সায়াদ বিন উবাদাহ প্রমুখ ও শাহাদতের আকাঙ্ক্ষায় যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করেন এবং মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে মতামত দেন অবশেষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সেদিন ছিল শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে ভাষণ। যুদ্ধ যাওয়ার প্রস্তুতি ও যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আছরের নামাজের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় কামরায় প্রবেশ করেন। তখন সাদ বিন মুয়ায এবং উসাইদ বিন হাজির (রা.) সবাইকে ডেকে বললেন, তোমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মদিনা হতে বের হয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছ। তোমাদের উচিত ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
ইতোমধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে বের হয়ে আসলে সরলমনা সাহাবিগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাধ্য করায় লজ্জিত হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা ভুলক্রমে আপনাকে বাধ্য করছি যা করা আমাদের উচিত হয়নি। আপনি আপনার মতানুসারে কাজ করেন, একথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কোনো নবীর জন্য যুদ্ধের পোশাক পরিধান করার পর দুশমনের সাথে ফয়সালা না করে যুদ্ধের পোশাক খোলা উচিত নয়। এখান থেকে শিক্ষা হলো যে কোনো মজলিসে সকলই পরামর্শ দিতে পারবে তবে আমীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সিদ্ধান্তের পর আল্লাহর ওপর ভরসা করা। (নাসরুল বারী শরহে বুখারি-১১৬-১৭)
লেখক : শিক্ষার্থী, মাহাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহিল ইসলামী, ঢাকা
ইবাংলা/ এশো/ ১০ মার্চ, ২০২২