১৯৯১ সালের ২৬ মে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাল্যবিয়ের শিকার হন তিনি। বাবা মায়ের ছোট ছিমছাম পরিবার থেকে নয় ভাই-বোনের রক্ষণশীল যৌথ পরিবারে হয় নতুন ঠিকানা। বাড়ির বড় বউ হওয়ায় তার কাঁধে চাপে সকল দায়িত্ব। তবুও হাল ছাড়ার মানুষ নন তিনি!
সকালে রান্নাবান্নার পালা শেষ করে ক্লাসে যেতেন। ক্লাস থেকে ফিরে আবার সেই রান্না ঘরে। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে পরিবারের সবাই যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন তিনি শ্বাশুরির পান বাটায় সুপারি কেটে দিতে দিতে পরের দিনের রান্নাবান্নার আয়োজন বুঝে নিতেন। এরপর নিজ ঘরে গিয়ে বসতেন পড়ার টেবিলে। পরীক্ষার সময় যেতেন বাবার বাড়ি। সেখান থেকেই অংশগ্রহণ করতেন পরীক্ষায়। এমন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পড়াশোনা করেই আলিম পরীক্ষায় প্রথম গ্রেডেসহ মেধা তালিকায় মাদ্রাসা বোর্ডের মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি।
আলিম পাসের পর মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পেয়ে আশাহত হয়ে পড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও বাড়ির বাহিরে থাকার রীতিনীতি শ্বশুড় বাড়ির না থাকায় শেষ পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন সরকারী আজিজুল হক কলেজে। এরপর কোল জুড়ে ধরণীতে আসে তার বড় মেয়ে মাসুমা মরিয়ম। সংসারের দায়দায়িত্ব, মেয়ের যত্নআত্তি, নিজের পড়াশোনা সবকিছু সামলাতে আবারো নাজেহাল অবস্থা। রাতে মেয়েকে দোলনায় রেখে পায়ের আঙ্গুলের সাথে দোলনার দড়ি বেঁধে দোল দিতে দিতে পড়তেন তিনি। যেতে পারতেন না প্রতিদিন কলেজে। কিন্তু যেদিন যেতেন সে দিন হতো আরেক নতুন গল্পের আবর্তন। সেদিন অনেক সকালে শ্বশুড় বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি যেতেন। বাবা ও ছোট বোনদের কাছে মেয়েকে রেখে কলেজে যেতেন। কলেজ থেকে ফিরে বাবার বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে আবার সাধুবাড়ীতে (শ্বশুর বাড়ী)। এভাবেই মেয়েকে বড় করা আর তার পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া।
যাঁর গল্প বলছি, তিনি বগুড়ার সন্তান শাহনাজ পারভীন। একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার দাড়িগাছা গ্রামে যাঁর কেটেছে শৈশব।
ছোটবেলা থেকেই স্কুল স্কুল খেলতে পছন্দ করতেন তিনি। খেলার সাথীদের শিক্ষার্থী সাজিয়ে শিক্ষক হতেন নিজে। কোনদিন যদি খেলার সাথীদের না পেতেন সেদিন ঘর এঁকে শিক্ষার্থীদের নাম লিখে কল্পনায় ছাত্রছাত্রী সাজিয়ে বিরাট একটি কাঠি (বেত) নিয়ে মেঝেতে আওয়াজ করে পড়তে বলতেন।
শত প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে শাহনাজ পারভীন বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি বাবা-মা খুব পরিশ্রম করত। সারাদিন মা স্কুলে পড়াত, তারপর বাসায় এসে রান্না করত আর রাতে হেরিকেনের আলোয় মেঝেতে চট বিছিয়ে আমাদের তিন বোনকে পড়াত। বাবা অসুস্থ, বড় ভাই-বোন না থাকায় অনেকেই বাবা-মাকে বলত মেয়েদের বেশী পড়ায়ে কী হবে, ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিন। অনেকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসত। কিন্তু বাবা-মা চাইত আমাদেরকে পড়াশুনা করিয়ে স্বাবলম্বী করতে।
বাবা চাইতেন মেয়ে ডাক্তার হবে। তাই মেয়ে ডাক্তারই হয়ে চেয়েছেন। কিন্তু রক্তে প্রবাহিত শিক্ষক। শিক্ষকরা কিভাবে কথা বলে, কিভাবে হাঁটে, তাদের পোশাক, তাদের পড়ানোর কৌশল সবকিছু। শৈশব থেকেই অনুকরণ ও অনুসরণ করতে তিনি। তাই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নটাও তার ভিতরে ছিল।
শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, মায়ের কাছে শুনেছি মা সেই সময় মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, নৌকা নিজেই বেয়ে নদী পার হয়ে স্কুলে পড়াশুনা করে অত্র এলাকার মধ্যে মেট্রিক পাশ করেছিলেন। মা কলেজে পড়ার সময় আমার জন্ম হয়। আমাকে কোলে নিয়ে কলেজে ক্লাস করতেন। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন, স্কাউটিং করেছেন। মাকে দেখেই শিক্ষকতার প্রতি ভালবাসা, ভাললাগা তৈরি হয়েছে।
শাহনাজ পারভীন বলেন, আমি সেবক হতে চাই দেশ, রাষ্ট্র তথা এই জাতির। আমি হত দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চাই। যদি সুযোগ থাকে তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ প্রধান হতে চান। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চাই।
২০১৬ সালের ১৯ জুলাই। উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানরত। ঠিক ঐ সময় প্রাথমিক অধিদপ্তর থেকে তার নামে আসে একটি ই-মেইল। সেই ই-মেইলে দেখতে পেলেন জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ৬ জন শিক্ষককে ভার্কি ফাউন্ডেশনে আবেদন করার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। দেশ সেরা শ্রেষ্ঠ ৬ জন শিক্ষকদের আবেদন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়। মন্ত্রণালয় সবার আবেদন যাচাইবাছাই করে তাকে মনোনয়ন পত্রটি ইউনেস্কোতে পাঠানো হয়। ইউনেস্কো তার লিখিত আবেদনটি ভার্কি ফাউন্ডেশনে গ্লোবাল টিচার প্রাইজের জন্য মনোনীত করে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগীতায় অনলাইনে আবেদন করেন। ভার্কি ফাউন্ডেশন ৪/৫ মাসব্যাপী প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিয়মিত বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট দিত, তা সম্পন্ন করে আবার ভার্কি ফাউন্ডেশনে পাঠান তিনি। ১৭৯টি দেশের ২২ হাজারের বেশি আবেদনের মধ্যে থেকে যাচাইবাছাই করে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সেরা ৫০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র তিনিই জায়গা করে নিয়েছিলেন।
গ্লোবাল টিচার পুরস্কার পাওয়ার পেছনের গল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করার পর অনেকেই আমাকে টিটকারী করত মাস্টার্স পাস (এম.এ) করে প্রাইমারি পন্ডিত হয়েছে। তখন থেকেই আমার ভিতরে তাড়না কাজ করত যে আমি তো শুধু সাধারণ শিক্ষকের মতো পেশা হিসাবে শিক্ষকতা বেছে নেইনি। আমি মানুষ গড়ার কারিগর হব, আমার সেরাটা দিয়েই আমি সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুশিক্ষিত জাতি উপহার দিব।
দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষণ শেখানো পদ্ধতি বদলাতে লাগলেন। পাশাপাশি হঠাৎ করে মাঝে মাঝে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে লাগল। বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্কুলে ঝড়ে পরার কারণ জানার জন্য বাড়ি বাড়ি যাওয়া শুরু করলেন। শুরু করেন গবেষণা ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় সব শিক্ষার্থী কেন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে ব্যার্থ হয়’। প্রায় ৮০টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর গবেষণা করে দেখেন বাল্যবিবাহ, দারিদ্র, বিনোদনের অভাব, বখাটের উৎপাত, শিশুশ্রম এসব কারণে ঝড়ে পরছে শিক্ষার্থীরা। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করলেন। সেজন্য তিনি ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা করতে চাইলেন। তখন নিজ বাড়িতে এনে সেসব শিশুদের অবসর সময়ে পাঠদান শুরু করেন। সুবিধাবঞ্চিত, ঝরে পড়া শিশুদের সু-শিক্ষা দান, দেশ ও জাতির শিক্ষায় উন্নয়ন মূলক কাজ, স্কাউটিং করাসহ সমাজের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করার কারণে তিনি গ্লোবাল টিচার পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশী হিসাবে তিনিই এ পুরস্কার অর্জন করেছেন।
শেরপুর শিশু কল্যান প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরুর পেছনের গল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার দুই মেয়েকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে ষ্ট্যান্ডে যেতাম। তখন দেখতাম বিভিন্ন দোকানে ছোট ছোট শিশুরা কাজ করছে এবং কাজের ফাঁকে ব্যাগ কাঁধে নেওয়া স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখমুখে আলো দেখতে পাই। ২০১৩ সালে স্বামী, মেয়ে ও পাড়ার মুরব্বীদের অনুপ্রেরণায় বাড়ির উঠানে শ্রমজীবী ও ঝরে পড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান শুরু করি।
ধীরেধীরে শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ির পাশেই একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ২ জন মহিলা শিক্ষক নিয়ে পড়াতে থাকেন। মানুষের কু কথা না শুনে, বিকাল ও সন্ধ্যায় ২ জন শিক্ষিকাকে সঙ্গে নিয়ে শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে যান। পাশাপাশি খেলাধুলা, টিফিন, বই খাতা, কলম, নতুন ড্রেস দিয়ে শিশুদের খুশি করার ব্যবস্থা করতেন। ২০১৫ সালে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ জন হওয়ায় বিদ্যালয়ে রূপ দেন। নাম দেন ‘শেরপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ২০১৬ সালে ১২ ডিসেম্বর শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত হয় বিদ্যালয়টি। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ৫ জন শিক্ষক, একজন অফিস সহকারী ও ১১৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
২০০৯ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত, ২০১০ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত, ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত, ২০১৩ শেরপুর সাহিত্য চক্র থেকে প্রিয় প্রজন্ম পুরষ্কার প্রাপ্ত, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কাব শিক্ষক নির্বাচিত, ২০১৭ সালে বগুড়া জেলা সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরষ্কার, ২০১৭ সালে গ্লোবাল টিচার প্রাইজ অর্জন শাহনাজ পারভীনের সাফল্যের ঝুড়িতে জমা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে আরো অনেক অনেক সম্মাননা ও প্রকাশনা।
১৯৮৫ সালে প্রাথমিকে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি, ১৯৯০ সালে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ প্রথম গ্রেডে দাখিল, ১৯৯২ সালে আলিম পরীক্ষায় প্রথম গ্রেডেসহ মেধা তালিকায় মাদ্রাসা বোর্ডের মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন, ১৯৯৬ সালে স্নাতক ও ১৯৯৭ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। এরপর সি-ইন-এড, বি.এড ও এম.এড ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি বগুড়া জেলার শেরপুর থানার উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
ইবাংলা/ এশো/ ১০ মার্চ, ২০২২