জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।এটা স্বাভাবিক। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা সমন্বয় করার কাজ শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশও করেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোও নিয়মিত তেলের দাম সমন্বয় করেছে।এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হয়।
সম্প্রতি জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ক্রয় ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করেছে। যা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কিন্তু যতদিন সম্ভব ছিল, দেশের মানুষের কথা মাথায় রেখে জ্বালানির দাম বাড়ানোর কল্পনাও করেনি সরকার।জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস কোনও সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না, সবটাই আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে
আরও পড়ুন…তারেক কানেকশন হাশেম রেজা আওয়ামী লীগে ভর করে অস্বাভাকি উত্থান
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আর এ সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার প্রধান শর্তই হলো জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া।
শনিবার (৬ আগস্ট) ২০২২ তথ্যও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম ভারতের দামের কাছাকাছি এবং অনেক প্রতিবেশী দেশের তুলনায় কম।গত বছর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। প্রতিবেশী দেশগুলো খুব বেশি ভর্তুকি দেয়নি এবং অনেক আগেই জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেল মূলত ভোক্তা পর্যায়ে ব্যবহৃত হওয়া একটি পণ্য। জনগণ সরাসরি এটা ব্যবহার করে তাই জনগণকেই বৈশি^ক দামের সাথে তাল মিলিয়ে এর যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং এর ব্যয়ভার বহন করতে হবে। সরকার এখানে কোনো ভর্তুকি দেবে না। সরকার ভর্তুকি দেবে বিভিন্ন সেবামূলক খাতে।নিচের তালিকা থেকে বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেলের বর্তমান বাজার মূল্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়:
আরও পড়ুন…ভাগিনার খোলা চিঠি (১২)
বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেলের মূল্য (লিটার/টাকায়)
দেশ ডিজেল অকটেন
বাংলাদেশ ১১৪ ১৩৫
ভারত ১১০.৯৫ ১২৩.৬৫
চীন ১১৮.৬৩ ১৩১.৯৯
আরব আমিরাত ১২২.৮০ ১১৬.৬৪
নেপাল ১২৭.৮২ ১৩৪.৫৫
ইন্দোনেশিয়া ১৩৮.২৪ ১১৬.২৬
সিঙ্গাপুর ১৮৯.৭৮ ১৯০.৪৫
হংকং ২৬০.৭৫ ২৮৪.৭২
উপরের তালিকা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, শুধু বাংলাদেশ নয় বিশে^র অন্যান্য দেশও বিশ্ব বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। বরং বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশি অনেক দেশের তুলনায় জ্বালানি তেলের দাম তেমন বৃদ্ধি করেননি।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি গত ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। সুফল ভোগ করবে জনগণ কিন্তু যখন বৈশ্বিক কারণে তেলের দাম বৃদ্ধি পাবে তখন জনগণ আর এর দায় নেবেনা তা তো হয় না।
আরও পড়ুন…জনতার হাতে ডিবি পুলিশ এএসআই আটক
সরকারি হিসেব মতে, ২০২১ সালে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি বাবদ ৪,৭০০ কোটি টাকা লাগলেও অবাক করা ব্যাপার হলো ২০২২ সালে সেই একই পরিমাণ জ্বালানির জন্য এলসি খুলতে হয়েছে ৯,৬০০ কোটি টাকার। তাহলে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার যে বাড়তি দিতে হলো এর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতিই দায়ী নয় কি? অর্থনীতির চাহিদা এবং যোগান রেখার মতোই বৈশ্বিক পরিস্থিতি। চাহিদা বেশি কিন্তু যোগান কম ফলে মূল্যও বেড়ে যায়।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটে যে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বড় অংশই জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য। গত মাসে আইএমএফ’র একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিলো এবং সে সময় সরকারকে এ ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিলো। আর এ ভর্তুকি কমানোর কারণেই জ্বালানি তেলের বাজার মূল্য হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। যেহেতু সরকার আর এ ভর্তুকি দেবে না তাই ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দকৃত যে অর্থ সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত এখন জনগণের উপর এসে পড়েছে। কিন্তু সরকারের এ পরিস্থিতিতে কিছু করার নেই। কারণ, ইচ্ছা করলেই সরকার দীর্ঘকালীন ভর্তুকির ব্যয়ভার বহন করতে পারবে না। কারণ তাহলে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় দুই বছরের মধ্যে প্রথম বারের মত ৪০ বিলিয়ন বাচার হাজার কোটি ডলারের নীচে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে বাংলাদেশের এখন রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৭৭ মার্কিন বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ কমে গেলে প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য আমদানি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে যার ফলে অর্থ সংকট শুরু হবে।
আরও পড়ুন…বাসে ডাকাতি ও দলবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতারকৃত ১০ জনকে আদালতে তোলা হবে
আবার অন্যদিকে বিশ্বে আর একটি সংকট শুরু হয়েছে আর তাহলো ডলার সংকট এবং কয়েক মাস ধরে ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ও সমস্যায় পড়েছেন আমদানিকারকরা। বাংলাদেশ সরকার জনবান্ধব সরকার কিন্তু তাই বলে দেশ চালানোর জন্য সরকার কী অন্য দেশ থেকে সাহায্য চাইবে নাকি নিজে ব্যবসা করে বা অন্য উপায়ে অর্থ উপার্জন করে ব্যক্তিগতভাবে দেশ চালাবেন। কোন দেশের সরকার মূলত এ ধরনের কাজ করেন না বরং প্রত্যেকটা দেশের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে প্রত্যেক দেশের সরকারই বাজেটে আয় এবং ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরেন।
অর্থাৎ সরকার এক উৎস থেকে আয় করেন এবং অন্য উৎসে ব্যয় করে থাকেন। আর জ্বালানী তেলের দাম যেহেতু বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বেশি এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যেহেতু দীর্ঘ মেয়াদী ভর্তুকি প্রদান করা সম্ভব না তাই স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার তেলের দামের সমন্বয় করেছেন যাতে বাংলাদেশ অর্থ সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া না হয়ে যায়।
ইবাংলা/জেএন/৯ আগস্ট,২০২২