নজরদারিতে শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, প্রবাসী প্রচারকদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গোয়েন্দা সংস্থা

মাসউদুর রহমান

ইউটিউব ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার বিরোধী প্রচারণা ও গুজব প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। দেশে-বিদেশে বসে যারা এসব কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং বা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে সহস্রাধিক ফেসবুক আইডি ও অর্ধশতাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানলকে চিহ্নিত করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

এসব ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নাম, ছবিসহ বিমানবন্দরে তালিকা দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তিদের বিদেশ যেতে ও বিদেশ থেকে দেশে আসার পথ বন্ধ। তারা বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যেতে চাইলে এবং বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসতে গেলে বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার হবেন। এরই মধ্যে ৩৫ মামলায় ৪৪ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র মতে, দেশে-বিদেশে বসে যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে একাধিক সেলও গঠন করেছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। তারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ এই দলের অঙ্গ-সংগঠনের অনেক লন্ডন প্রবাসী নেতাকর্মীরা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন।

এ তালিকায় রয়েছেন- যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক কনক সারোয়ার, ফরিদ আলম, ইলিয়াস হোসেন, ফ্রান্স প্রবাসী পিনাকী ভট্টাচার্য, লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক মাহবুব আলী খানসুর, জোবায়ের আহমেদ, সেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি সেলিম সরদার শওকত, যুগ্ম-সম্পাদক মো. আব্দুর রহমান, সুহেল আহমেদ, হুমায়ুন কবির, ফয়সাল আহমেদ, পারভেজ আহমেদ, চৌঃ তাকি তাজওয়ার বোরহান উদ্দিন চৌধুরী, সালমান আহমদ ও ফয়েজ উল্লহ, লন্ডন প্রবাসী শিবিরের সাবেক নেতা নওশিন মুস্তারি মিয়া সাহেব, সায়েম আহমেদ, মোহাম্মদ মাসুদুল হাসান, আলামিন, যুক্তরাজ্য বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতা মির্জা এনামুল হক, শরিফ রানা, জুবায়ের আহমদ, আবু জাফর, জাকারিয়া, আনোয়ারুল আমিন, আজিজুর রহমান, আকলাকুর রহমান মিতুল, আবদুস সালাম, সাবেক ছাত্রদল নেত্রী শারমিন আহমেদ, অন্যতম। এসব ব্যক্তি দেশে আসা মাত্র বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার হবেন।

এদিকে, অনলাইন ও ইউটিউব চ্যানেলগুলোর তালিকায় রয়েছে – তারেক রহমানের নির্দশনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত ইউটিউব টিভি এনসিএন, ইলিয়াস হোসেন ফিফটিন মিনিটস্, কনক সারোয়ার নিউজ, যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালিত এআরপি ভিশন চ্যানেল, সংগ্রাম টিভি, আন্দোলন নিউজ, আমার দেশ ইউকে, আনোয়ারুল আমিন নিউজ চ্যানেল, বিএনপি ইউকে, বিএনপি নিউজ ইউরোপ, খালেদা জিয়া মুক্তি আন্দোলন ইউকে ইত্যাদি।

এসব ইউটিউব চ্যানেলের পেছনে বিএনপি, জামায়াত এবং সাবেক ছাত্রদল-শিবিরের লোকজন তাদের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যে সহস্রাধিক ফেসবুক আইডি ও অর্ধশতাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল চিহ্নিত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও নেওয়া হয়েছে। দেশে থেকে যারা এ ধরনের গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত তারা দেশ থেকে যেন পালাতে না পারে সেজন্য আদালতের নির্দেশনা নেওয়া হয়েছে। আর যারা বিদেশ থেকে দেশে আসবেন তারা যেন বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার হন সে বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। এমনকি এদেরকে গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।

এদিকে যেসব বাংলাদেশি বিদেশে বসে সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের উপরে প্রবাসেই প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাগরিক সংবর্ধনা বিষয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ। ওই সংবাদ সম্মেলনে নিউইয়র্ক থেকে প্রচারিত এনসিএন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক ফরিদ আলম প্রশ্ন করেন, জাতিসংঘের অধিবেশনে বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রীরা ছয়-সাতজন সফর সঙ্গী নিয়ে অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। সেখানে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশাল বহর নিয়ে এসেছেন এই করনোকালে এটা কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন। আর আপনারা এতো নেতাকর্মী থাকতে আমাদের মতো উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পার্কের একটি বেঞ্চ উদ্বোধন করিয়েছেন এটা কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্ন করার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ওই সাংবাদিকের ওপর হামলা করেন। এসময় অন্য সাংবাদিকরা ফরিদ আলমকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।

এছাড়াও বেশ কিছুদিন আগে নিউইয়র্কের একটি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সাংবাদিক ইলিয়াসের ওপর হামলা করেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

এছাড়াও ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশকিছু আইপি টিভি।

সে তালিকায় রয়েছেন-জাগোবিডি,বাংলা২১ টিভি, মিলেনিয়াম টিভি, রেডিয়েন্ট আইপি টিভি, এটিএন মিউজিক, টাইম টেলিভিশন, লাইভ২ওয়েভ টিভি, বরেন্দ্র টিভি, রং টিভি, এটিএন ইসলামিক টিভি, মুভি বাংলা টিভি, টাইমস২৪ টিভি, প্রবাসী টিভি, আরটিভি মিউজিক, টোটাল ক্যাবল, নকশী টিভি, জয় টিভি, বী আইপি টিভি, প্যানাভিশন টিভি, চ্যানেল এস বিডি, এনআরবি টিভি, ৭১ বাংলা টিভি, টিভি ওয়ান ইউকে, দেশেবিদেশে, আইওএন টিভি ইউকে, দাওয়াহ টিভি, ম্যাজিক বাংলা টিভি, মাদানী বাংলা, ইকরা বাংলা টিভি, ডিজি বাংলা টিভি, মাই সিনেমা, রোয়াল টিভি, আলিফ টিভি, জন্মভূমি টিভি, এবি টিভি ইউএসএ, জয়যাত্রা টিভি, কিউ টিভি, কুমিল্লা২৪, কালারশিপ টিভি, হারনেট টিভি, নারী টিভি, আল্পনা টিভি, আযান টিভি, গ্লোবাল বাংলা টিভি, ঢাকা টিভি, এনটিভি বাংলা, চ্যানেল টি ওয়ান, জাগরণী টিভি, এনএএন টিভি, এমবি টিভি, স্বপ্ন টিভি, মুভি ২, বিশ্ব বাংলা২৪, আরএনএন টিভি, ফ্ল্যাশ টিভি, চ্যানেল এইচ, সিটি টিভি, ঝংকার টিভি এবং টিভি৭।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ গণতান্ত্রিক পুলিশিং ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। তাই অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করে। মিথ্যাচার তথা প্রপাগান্ডা সাংবিধানিকভাবে ও প্রচলিত আইনে একটি অপরাধ। তাই যারাই অনলাইনে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়াবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসব বিষয় নিয়ে আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কাজও শুরু করেছি।

এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মক্কার বুর্জ আল সুলতান হোটেলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম জানান, প্রবাসে বসে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী গুজব প্রচারকারীরা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ইতোমধ্যে প্রায়ই অর্ধশতাধিক ফেসবুক পেজ, টুইটার এর সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রবাসীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশে গেলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে।

এডিসি হারুন অর রশিদ বলেন, গোয়েন্দা পুশিলে একটি সাইবার ইউনিট হয়েছে। কারা কি বলছে আমরা কিন্তু সেটা খেয়াল রাখছি।আমরা গোয়েন্দা পুলিশ সাইবার ইউনিট প্রতিনিয়ত প্রতিক্ষণে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে যারা বিভিন্ন স্তরের মানুষকে বিভ্রান্তি করছে, বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছে, আমরা কিন্তু সেসব যাচাই-বাছাই করছি এবং অনেককে আমরা ধরেছি যারা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন তাদের আমরা জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছি আর যারা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। আগামী দিনেও যারা ইসলাম এবং হাসিদের নাম ব্যবহার করে, কোরআনের নাম ব্যবহার করে, মানুষকে বিভ্রন্তি করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিব এবং তাদের অনেককেই আমরা নজরদারিতে রাখছি।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, কোনো অপপ্রচারকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।

Comments (0)
Add Comment