পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)। আল্লাহর কাছে সব মানুষের অধিকার সমান। যে আল্লাহর ইবাদত করে না তার জমিনেও আল্লাহ বৃষ্টির পানি দিয়ে ফসল ফলান। আলো-বাতাস-অক্সিজেন সবাইকে তিনি সমানভাবে দিয়ে যাচ্ছেন। সৃষ্টিগত দিক থেকে সব মানুষ সমান। পৃথিবীতে সব মানুষই তার ফিতরাতের ওপর জন্ম নেয়। বাবা-মায়ের কারণে মানুষ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়। তবে ইসলাম কারও ধর্মের ওপর জোর-জবরদস্তি করাকে সমর্থন করে না। যার নমুনা হিসেবে আমরা দেখেছি, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই রোজা আর পূজা একসঙ্গে পালিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের সুমহান আদর্শ পৃথিবীবাসীকে আকৃষ্ট করেছে। অমুসলিমদের প্রতি বিশ্বনবী রহমাতুল্লিল আলামিনের আচরণ ও মানসিকতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।
আরও পড়ুন…পুঁজিবাজারে ট্রেজারি বিল ও বন্ড লেনদেনের উদ্যোগ
ইসলাম সুনিশ্চিত করেছে সব ধর্মের স্বাধীনতা। যে যার ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে, ইসলাম তাতে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করবে না। সামাজিকভাবেও সম্প্রীতি বজায় রেখে একই এলাকায় বসবাসে উদ্বুদ্ধ করেছে বিশ্ববাসীর কাছে প্রিয় ধর্ম ইসলাম। সামাজিক সাম্য ন্যায় ইনসাফ শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। বিশ্বনবীর আদর্শ হলো-ওঠবস, লেনদেন, বসবাস, কাজকর্ম ইত্যাদি সবার সঙ্গে সম্প্রীতি রক্ষা করেই করতে হবে। এই জন্য শান্তিময় সুখী সমৃদ্ধশালী একটি সমাজ, দেশ উপহার দিতে বিশ্বনবীর (সা.) আদর্শ অনুসরণের বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আদর্শই একমাত্র গ্রহণযোগ্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে আল্লাহ তায়ালারও ঘোষণা রয়েছে। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব-২১)।
অনুকরণী আদর্শ যেই মহামানবের মধ্যে রয়েছে তিনি যা করতে বলেছেন তা করতে হবে এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। আর এটাই হলো আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাসুল (সা.) তোমাদের জন্য যা এনেছেন তা গ্রহণ করো, আর যা থেকে তিনি তোমাদের বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত হও, আর আল্লাহকেই ভয় কর।’ (সুরা হাশর-৭)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজির (সা.) আদর্শ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন, রাসুলুল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক জীবনের সব কিছু গ্রহণ এবং বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে বললেন কেন? উত্তর আসবে-তিনিই পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি, যার চরিত্রে কোনো কলঙ্ক নেই। তার চরিত্রের সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেই দিয়েছেন।
কালামে পাকে এরশাদ হয়েছে, ‘আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা কলমণ্ড৪)। শুধু চরিত্রের সার্টিফিকেটই দেননি। এই পৃথিবীতে আল্লাহর পরে তাঁর প্রিয় রাসুলের খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত নবীজির খ্যাতি সব কিছুর ওপরে, তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘হে রাসুল (সা.) আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদায় তুলে ধরেছি।’ (সুরা ইনশিরাহ-৪)।
কোরআনুল কারিমে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যে মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, তা বিশ্ববাসী নবীজির বাস্তব জীবনে প্রমাণ পেয়ে গেছে। সুরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তো আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য শুধু রহমত রূপেই পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া-১০৭)। পথহারা পথভোলা মানুষের জন্য তিনি রহমতের নবী দয়ার সাগর কামলে ওয়ালা রাহবার। নবীজির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো-তিনি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তো আপনাকে পাঠিেেয়ছি শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে।’ (সুরা ফুরকান-৫৬)। পৃথিবীবাসী বোঝে না যে, রহমতের নবী কাউকে জবরদস্তি করে ইসলামের দিকে আনেননি। তিনি সুসংবাদ দিয়েছেন, আর অকল্যাণের দিকগুলো তুলে ধরে সতর্ক করেছেন মাত্র। মানুষ না বুঝে তাকে চিনতে না পেরে অশ্রাব্য মন্তব্য করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তো আপনাকে সব মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা আর সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সুরা সাবা-২৮)।
আরও পড়ুন…এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ বাছাই গ্রুপে টানা দ্বিতীয় জয় বাংলাদেশের
এখন জানার বিষয় হলো আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব কী দিয়ে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তো বলেছেন, নবীজি তোমাদের জন্য যা এনেছেন। তিনি কী এনেছেন? এমন প্রশ্ন যদি করি তাহলে কোরআন তার জবাব দিচ্ছে, ‘নিশ্চয় আমি আমার রাসুলদের পাঠিয়েছি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এবং তাদের সঙ্গে কিতাব ও ন্যায়ের মানদণ্ড নাজিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।’ (সুরা হাদিদণ্ড২৫)। সুতরাং নবীজি হলেন ন্যায়, ইনসাফ ও মানবতার মূর্ত প্রতীক। যে রাসুল (সা.) স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে এতগুণ ও মর্যাদার সনদ পেয়েছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় তাঁর আদর্শ কেমন ছিল? তাই বলতেই হবে, এমন একজন বিশ্ব মহামানবের আদর্শই শুধু পারে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় বিশ্বনবী (সা.) এর আদর্শ
রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দেওয়া ওহির জ্ঞানের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি সুরক্ষা করেছেন। সাহাবারা একইভাবে নবীজির পথ অনুসরণ করেছেন। যুগে যুগে নবীজির উম্মতরা ওই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পৃথিবীতে রেখে যাচ্ছে ন্যায়ের দৃষ্টান্ত আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মুজাচ্ছাম নমুনা।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কাকে বলে তা শিখতে হবে বিশ্ব নবীর (সা.) এর আদর্শ থেকে। তিনি ওহির জ্ঞান দ্বারা মানবজাতিকে সম্প্রীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বল, হে মানবমণ্ডলী! আমার দ্বীনের ব্যাপারে যদি তোমাদের কোনো প্রকার সন্দেহ থাকে, তাহলে জেনে রেখ, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার ইবাদত কর, আমি তাদের ইবাদত করি না, বরং আমি সেই আল্লাহর ইবাদত করি যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান।’ (সুরা ইউনুস-১০৪)। আহ! কী চমৎকার! দয়ার নবী আল্লাহর শেখানো ভাষায় কত সুন্দর ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বললেন। অর্থাৎ ‘তোমাদের মতো তোমরা ইবাদত করো তাতে আমাদের কোনো বাধা-বিপত্তি নেই, আমরা শুধু দাওয়াত দিই এই যে, তোমাদের মৃত্যু তো নিশ্চিত তাই তোমাদের মৃত্যু যিনি ঘটান আমি তাঁর ইবাদত করি। বাড়াবাড়ি করব না, ইসলাম তো বাড়াবাড়ি শেখায়নি।
আরও পড়ুন…আম্বরখানা-টুকেরবাজার চার লেব সড়কের উদ্বোধন করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আল্লাহ পাক বলেন, দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ এই তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে, যা কখনও ছিন্ন হওয়ার নয়।’ (সুরা বাকারা-২৫৬)। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে তার বাপ-দাদার ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে চায়, তাকে তার ওপরই থাকতে দাও।’ (মুয়াত্তা মালিক-৬৫৫)। কেউ কারও ধর্মের উপাসককে যেন গালমন্দ না করে, এমন শিক্ষা দেয় ইসলাম। অন্য ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা যাবে না, মর্মে কোরআনে কারিমে আয়াত নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে (মূর্তিকে) তারা আহ্বান করে, তোমরা তাদের গালমন্দ করো না, তাহলে ওরাও সীমালঙ্ঘন করে মূর্খতাবশত তোমার আল্লাহকেও গালমন্দ করবে।’ (সুরা আনয়ামণ্ড১০৮)।
সুতরাং যার যার ধমর্, সেই সেই স্বাধীনভাবে পালন করুক। আল্লাহ পাক আরও পরিষ্কার করে বলেন, ‘তোমাদের পথ ও পন্থা তোমাদের জন্য (সে পথে চলার পরিণতি তোমাদেরই ভোগ করতে হবে) আর আমার জন্য আমার পথ (যে সত্য পথে চলার জন্য আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, এ পথ ছেড়ে আমি অন্য কোনো পথ গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত নই)।’ (সুরা কাফিরুন-৬)। সুতরাং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় বিশ্বনবী (সা.) কোরআনের ভাষায় এমন সুন্দর আদর্শিক নীতি ঘোষণা করলেন বিশ্ববাসীর কাছে। আজও মুসলিম উম্মাহ নবীজির রেখে যাওয়া আদর্শ মতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেছে।
সামাজিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : মুসলিমের প্রতিবেশী যদি অমুসলিম হয়, তার সামাজিক ধর্মীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সব ধরনের অধিকারের খেয়াল রাখা জরুরি করেছে ইসলাম। মহান আল্লাহর ঘোষণা-‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের ঘর বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়নি, তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে আর ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেনি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মুমতাহিনা-৮)।
বিশ্বমানবতার মহান কাণ্ডারি নবী করিম (সা.) এর কণ্ঠে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষিত হয়েছে।
‘হে মানুষরা! আল্লাহ এক এবং তোমাদের আদিপিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা রঙের মানুষ একজন কালো রঙের মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, আবার কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শুধু তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি আর বান্দার হক কতদূর আদায় করল তার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে হবে। এর মাধ্যমেই আল্লাহর কাছে তোমাদের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি)।
আরও পড়ুন…মধুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নব নির্মিত মসজিদ ভবনের উদ্ধোধন
সুতরাং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বংশ, সামাজিক মর্যাদা, বর্ণবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। এগুলোর বিভক্তি শুধু পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার হতে পারে। এ বিষয়টি তুলে ধরে মহান আল্লাহর এ ঘোষণা খুবই কার্যকরী। তিনি বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি, যাতে পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।’ (সুরা হুজরাত-১৩)।
মানুষ হিসেবে যার মর্যাদা যেমন; তার আচার-আচরণ ও তেমন। মহান আল্লাহ তায়ালা যেই নবীজির (সা.) সম্পর্কে এত মর্যাদা ও গুণ বর্ণনা করেছেন, সেখানে তার ব্যাপারে সন্দেহ থাকতেই পারে না, যে তিনি পরমর্ধ ও অমুসলিমদের সঙ্গে উত্তম আচরণের মাধ্যমে সম্প্রীতি বজায় রেখেছেন। পরধর্ম সহিঞ্চু ও অমুসলিমদের সামাজিক মর্যাদদানে পৃথিবীবাসীর জন্য তিনি মডেল। সুতরাং অমুসলিমদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আচরণ মুসলিম উম্মাহর জন্য অন্যত অনুকরণীয় আদর্শ।
বিশ্বনবী (সা.) সব মানুষের প্রতি ছিলেন উদার। ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠী বিচারে তিনি কারও প্রতি ন্যূনতম জুলুম করেননি। আবার কারও প্রতি জুলুমণ্ডঅবিচার হোক এটাও তিনি পছন্দ করেননি। তিনি তাঁর উম্মতের এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন-‘কেউ যেন কারও প্রতি জুলুম না করে; যেন সবার সঙ্গে উত্তম সদাচরণ করে।’ এক কথায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বিশ্বনবীর (সা.) এর আদর্শ ছিল তুলনাহীন। ইসলাম মতে অমুসলিমের সঙ্গে যুদ্ধের বিধান আছে সত্য, তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, যুদ্ধের ময়দানের বাইরে তাদের নিরাপত্তাদান ও তাদের জানমালে হেফাজতের কথা বলা হয়েছে। বিশ্বনবী (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেছেন, যা আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণ ও পাবেন।’ (ইবনে মাজাহ-২৬৮৬)।
কোনো একদিন এক ইয়াহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর ওই লাশের সম্মানার্থে নবীজি (সা.) দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন হজরত জাবের (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এটি তো ইয়াহুদির লাশ! তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?’ (বোখারি-১৩১২)।
আরও পড়ুন…জাতীয় দিবসে চীনাদের ‘দ্বিতীয় শত বছর’ সংগ্রামের লক্ষ্য নিয়ে আলোচন
রাসুলুল্লাহ যখন মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান তখন তিনি ‘মদিনা সনদ’ ঘোষণা করেন। ঐতিহাসিক ওই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ অমুসলিম বা সংখ্যাধিক্য যাদের কম, তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত বিষয়গুলোও উল্লেখযোগ্য ধারা হিসেবে স্থান পেয়েছিল। নবীজি রাষ্ট্রনায়ককালে মদিনায় মুসলমান, ইহুদি এবং আওস ও খাযরায মিলে মোট ১২টি উপগোত্রের লোকজনের বসবাস ছিল। ইসলামের প্রথম যুগের চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে ‘মদিনা সনদ’-এর আলোকে সব গোষ্ঠী সম্প্রদায়িক দাঙা ছেড়ে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণভাবেই সহাবস্থান করেছিলেন, যা নতুন ইসলামি রাষ্ট্র মদিনাকে একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
বার্তাবাহক বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.) ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্যমৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেছিলেন। তৎকালীন সমাজের গোত্রগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অন্তর্কলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপুর্ণ সমাজ বিনির্মাণ করেছিলেন আখেরি জামানার পয়গম্বর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)।
শুধু তাই নয়, কোনো অমুসলিম অসুস্থ হলে তার সেবাযত্ন করা অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়া নবীজির সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে অমুসলিম রোগীদের দেখতে যেতেন এবং তাদের সেবাযত্ন করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সৃষ্টির সেরাজীব হিসেবে সম্মান করেছেন। হোক সে মুসলিম কিংবা অমুসলিম। অন্যায়ের ক্ষেত্রেও তিনি কারও সঙ্গে আপস করেননি। অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের পক্ষ অবলম্বন করে অমুসলিমের বিপক্ষে অবস্থান করেনি। তিনি ছিলেন সবার প্রতি উদার ও উত্তম আচরণকারী। মুসলিম কিংবা অমুসলিম যেই হোক, তার অধিকারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন।
সুতরাং আজও আমরা যদি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দেখানো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ উদার নীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে বিশ্বব্যাপী আবারও বইবে শান্তির সুবাতাস। ইসলাম ও মুসলমানদের লালিত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সুমহান আদর্শগুলো বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে হবে।আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দিকনির্দেশনা মেনে তাঁর আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তৌফিক দিন-আমিন।
ইবাংলা/জেএন/০৭ অক্টোবর ২০২২