তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে বেড়েই চলছে মৃতের সংখ্যা। জাতিসংঘের প্রথম সাহায্য সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পৌঁছানোর সাথে সাথে নিহতের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং আরও জীবিতদের খুঁজে পাওয়ার আশা ম্লান হয়ে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, তিনি সিরিয়া যাচ্ছেন। সেখানে প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে হাজার হাজার ধসে পড়া সমতল ভবনে অনুসন্ধানে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং আশ্রয় ও পানীয় জলের অভাবে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আন্তাকিয়ার একটি হাসপাতালের গাড়ি পার্কিংয়ে নিখোঁজ আত্মীয়দের খোঁজে সারিবদ্ধ করে রাখা বডি ব্যাগগুলো ট্র্যাজেডির মাত্রার ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয়। সিরিয়ান শরণার্থী রানিয়া জাবুবি বলেছেন, ‘আমরা আমার খালাকে পেয়েছি, কিন্তু আমার চাচাকে পাইনি’। রানিয়া তার পরিবারের আট সদস্যকে হারিয়েছেন। জীবিতদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এখন ম্লান হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে সম্ভাব্য সময় ৭২-ঘন্টার সীমা পেরিয়ে গেছে। ৭.৮-মাত্রার ভূমিকম্পটি সোমবার ভোররাতে মানুষের ঘুমের সময় আঘাত হানে এমন একটি অঞ্চলে, যেখানে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে অনেক লোক ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ‘হু’র প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসিস বৃহস্পতিবার বলেছেন, তিনি সিরিয়া যাচ্ছেন।
টেড্রোস এক টুইটে বলেছেন, ‘আমি সিরিয়া যাওয়ার পথে যেখানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ডব্লিউএইচও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে।’
আরও পড়ুন…ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন হবে: কাদের
বাব আল-হাওয়া সীমান্ত ক্রসিংয়ের একজন কর্মকর্তা এএফপি’কে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর প্রথম সম্ভাব্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা নিয়ে একটি বহর বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় পৌঁছেছে।
সিরিয়ার সরকারী বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর মধ্য দিয়ে না গিয়ে জাতিসংঘের সহায়তা বেসামরিকদের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় এই সীমান্ত ক্রসিং। এক দশকের গৃহযুদ্ধ এবং সিরীয়-রাশিয়ান বিমানের বোমাবর্ষণ ইতিমধ্যে হাসপাতাল ধ্বংস করেছে, অর্থনীতি ভেঙ্গে দিয়েছে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে নতুন আন্তঃসীমান্ত মানবিক সহায়তা কেন্দ্র খোলার অনুমোদন দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসরত চল্লিশ লাখ মানুষকে প্রায় এক দশক আগে নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত একটি আন্তঃসীমান্ত সাহায্য অভিযানের অংশ হিসেবে বাব আল-হাওয়া ক্রসিংয়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। গুতেরেস বলেছেন, ‘এখন ঐক্যের সময়, রাজনীতি বা বিভাজনের সুযোগ নেই তবে এটি স্পষ্ট যে, আমাদের ব্যাপক সমর্থন প্রয়োজন।
তুরস্কের শহর গাজিয়ানটেপের তাপমাত্রা বৃহস্পতিবারের শুরুতে মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এ নেমে আসে। কিন্তু হাজার হাজার পরিবার গাড়ি এবং অস্থায়ী তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে। তাদের বাড়িতে ফিরতে নিষেধ করা হয়েছে।সোমবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের কম্বলে জড়িয়ে শহরের রাস্তায় হাঁটছিলেন। কারণ, এটি তাঁবুতে বসে থাকার চেয়ে শরীরের উষ্ণতা ধরে রাখছিল।
জিম, মসজিদ, স্কুল এবং কিছু দোকান রাতে খোলা হয়েছে। কিন্তু বিছানা এখনও দুর্লভ রয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ উষ্ণতার জন্য ইঞ্জিন চালু রেখে গাড়িতে রাত কাটায়।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান বুধবার স্বীকার করেছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের ‘ত্রুটি’ ছিল।
সোমবারের ভূমিকম্পটি ১৯৩৯ সালের পর তুরস্কের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ছিল। আগের সেই ভূমিকম্পে পূর্ব এরজিনকান প্রদেশে ৩৩ হাজর মানুষ মারা গিয়েছিল। কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সোমবারের ৭.৮ মাত্রার কম্পনে তুরস্কে ১৭,৬৭৪ জন এবং সিরিয়ায় ৩,৩৭৭ জন মারা গেছেন, নিশ্চিত মোট নিহতের সংখ্যা ২১,০৫১-এ পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সংখ্যাটি ব্যাপক বাড়তে থাকবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আদিয়ামান প্রদেশের হাকান তানরিভার্দি এএফপিকে বলেন, ‘ভূমিকম্পে যারা মারা যায়নি তাদের ঠান্ডায় মারা যেতে হয়েছে।’ অসুবিধা সত্ত্বেও, হাজার হাজার দেশি এবং বিদেশী অনুসন্ধানকারী আরও বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সন্ধাে সের দ ন হাল ছেড়ে দেয়নি।
উত্তর সাইপ্রা ুই ডজন শিশু এবং তাদের কিছু অভিভাবক সব মিলিয়ে ৩৯ জন তুর্কি সাইপ্রিয়ট একটি ভলিবল টুর্নামেন্টে যোগ দিতে স্কুল ভ্রমণে যাচ্ছিল যখন ভূমিকম্পটি দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের আদিয়ামানে তাদের হোটেলে আঘাত হানে৷
তুর্কি সাইপ্রিয়ট অঞ্চলের সরকার একটি জাতীয় সংহতি ঘোষণা করেছে, একটি বেসরকারী বিমান ভাড়া করেছে যাতে তারা শিশুদের জন্য অনুসন্ধান ও উদ্ধার প্রচেষ্টায় যোগ দিতে পারে।
আরও পড়ুন…ভুমিকম্প দুর্গত জনপদে বাংলার মিশন
ইলহামি বিলগেন, যার ভাই হাসান ভলিবল দলে ছিলেন, তিনি কংক্রিটের স্ল্যাব এবং ভারী ইটের ভয়ঙ্কর স্তুপের দিকে তাকিয়ে বললেন ওখানে হোটেলটি ছিল।বিলগেন বলেন, ‘ওখানে একটা ফাঁপা আছে। বাচ্চারা এতে হামাগুড়ি দিয়ে থাকতে পারে।’ । ‘আমরা এখনও আশা ছাড়িনি।’
চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ কয়েক ডজন দেশ সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা ত্রাণ ও পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে তুরস্ককে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে।
তুরস্কে বিদ্যমান দুটি প্রকল্প থেকে ৭৮০ মিলিয়ন ডলারের তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া হবে। ব্যাংকটি বলেছে, যখন পুনরুদ্ধার এবং পুনর্গঠনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য ১ বিলিয়ন ডলারের কার্যক্রম প্রস্তুত করা হচ্ছে। ফিচ রেটিং বলেছে, ভূমিকম্পে বিপুল মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়াও, অর্থনৈতিক ক্ষতি সম্ভবত ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং ৪ বিলিয়ন বা তারচেয়েও বেশি হতে পারে।
ইবাংলা/টিএইচকে